StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর

 

আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট আলোচনা কর । আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের পটভূমি আলোচনা কর।

প্রেক্ষাপট :

১৮৩৯ থেকে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চীনের সঙ্গে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের একটানা দীর্ঘ সংঘর্ষের ফলে, চীনের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, বিশেষতঃ সামরিক দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে নানকিং-এর সন্ধি স্বাক্ষরের মাধ্যমে চীন তার ক্যান্টন ফুক্তো, নিংগো, অ্যামনা, সাংহাই প্রভৃতি পাঁচটি বন্দর ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। এছাড়া চীনের বন্দরে আমদানি-রপ্তানির ওপরে আরোপিত শুল্কের হার নির্দিষ্ট করা, অতিরাষ্ট্রিক ক্ষমতা দান প্রভৃতি স্বীকৃত হয়।

১৮৫৮ খ্রীস্টাব্দে টিয়েন্টসিনের সন্ধি ও ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে পিকিং-এর সন্ধির মাধ্যমে অপরাপর বিদেশী রাষ্ট্রগুলিও অনুরূপ সুযোগ সুবিধা লাভ করে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রকে অতিরাষ্ট্রিক অধিকার এবং অতি অনুগৃহীত রাষ্ট্রের (Most Favoured Nation Treatement) মর্যাদা দানের মাধ্যমে চীনের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়। চীনের মত অতিকায় রাষ্ট্রের পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের কাছে বারংবার পরাজয় চিন সরকারের এই বোধোদয় ঘটায় যে দেশের সামরিক আধুনিকীকরণ ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব নয় এবং পাশ্চাত্য সমর সরঞ্জাম ছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন  সম্ভব নয়। চীনা সরকার ও চীনা নেতৃবর্গ চীনকে পাশ্চাত্য আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা জন্য ও চীনকে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার জন্য চীনের আধুনিকীকরণ তথা পাশ্চাত্যকরণের (Westernisation) প্রয়োজন অনুভব করে। এই পাশ্চাত্যকরণ চীনের সার্বিক ক্ষেত্রে দেখা যায়নি, প্রধানত সামরিক ক্ষেত্রে সীমায়িত ছিল। 

চীন একথা বুঝতে পারে, যে শক্তির উপর ভিত্তি করে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে সেই পাশ্চাত্য প্রযুক্তিবিদ্যা ও প্রয়োগ কৌশল আয়ত্বের মাধ্যমে পাশ্চাত্য আগ্রাসন বন্ধ করা সম্ভব। ওয়েই ইউয়ান (Wei Yuan)-এর মত (১৭৯৪-১৮৫৬) চীনের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পণ্ডিতেরা উপলিব্ধ করেছিলেন যে বর্বরদের শক্তির দ্বারাই বর্বরদের পরাজিত করা সম্ভব। তাই পাশ্চাত্য প্রযুক্তি ও সমর সরঞ্জাম সংগ্রহ করার প্রতি চীনাবাসীর আগ্রহ জন্মে। ওয়েই ইউয়ানের ভাষায়: “Learn the superior techniques of the barbarians to control the barbarians”। (১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের পিকিং কনভেনসন থেকে ১৮৯৪-৯৫-এর চীন-জাপানের যুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে চীনে যে শান্তি বিরাজ করছিল তা আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের সময় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে ।

বৈদেশিক আক্রমণের বিরুদ্ধে রক্ষা কবচ রূপে “জু-চিয়াং” শব্দ দুটির উল্লেখ রাজাজ্ঞা, স্মারকলিপি ও অন্যান্য নথিপত্রে পাওয়া যায়। আত্মশক্তি বিকাশের প্রাথমিক পদক্ষেপ রূপে চীনে উন্নত নৌবাহিনী ও সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার কথা বলা হয়,যদিও আত্মশক্তি বিকাশের কূটনৈতিক, আর্থিক, শিক্ষা ও সামরিক দিক ছিল। যুবরাজ কুং-এর কূটনৈতিক আধুনিকীকরণের প্রয়াসের সমান্তরাল দিক ছিল আধুনিক নৌবাহিনী গড়ে তোলা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সেং কুয়ো ফ্যান (Tseng Kuo-Fan), সো সুং তার (Tso Tsung-Tang) এবং লি হাং চ্যাং (Li Hung Chang)-এর মত প্রখ্যাত প্রাদেশিক নেতাদের বিদেশী যুদ্ধ জাহাজ এবং বন্দুক সংগ্রহের, সহযোগী শিল্প সংগঠনের এবং নতুন প্রশিক্ষণ স্কুল খোলার মাধ্যমে সামরিক আধুনিকীকরণের প্রয়াস। তাদের এই ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের ফলেই চীনে আত্মশক্তি বিকাশের সূচনা হয়েছিল যা ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।

আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল চিং সরকারের সামন্ততান্ত্রিক সামরিক বাহিনী এবং আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, যাতে তারা দেশের অভ্যন্তরে গণকৃষক আন্দোলন ও অন্যান্য বিদ্রোহকে দমন করতে পারে। পাশ্চাত্যের প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্র সংগ্রহ করে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হওয়ার এই প্রয়াস প্রথম লক্ষ্য করা যায়। কমিশনার লিন সে সু (Lin Tse Hsu)-র মধ্যে। তিনিই প্রথম ম্যাকাও, সিঙ্গাপুর এবং ভারতে প্রকাশিত বিদেশী সংবাদপত্রগুলির অনুবাদের কথা বলেন।

ভ্যাট্রেলের (Vattel)আন্তর্জাতিক আইনের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ এবং মূরের (Murray)-র Cyclopaedia of Geography চীনা ভাষায় অনুবাদ তাঁরই উদ্যোগে হয়। পাশ্চাত্যের সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানই লিনের মনে ব্রিটিশদের সম্পর্কে শ্রদ্ধার জন্ম দিয়েছিল। তাই তিনি ক্যান্টনের প্রতিরক্ষার জন্য দুশো ( ২০০ ) বিদেশী বন্দুক জয় করেন এবং বন্দুক তৈরীর কৌশল সংক্রান্ত গ্রন্থের অনুবাদের নির্দেশ দেন। লিনের মতই কিছু চীনা পণ্ডিত যারা এই সময়কেই চীনের বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের এক নতুন যুগরূপে চিহ্নিত করেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলেন ওয়েই ইউয়ান (Wei Yuan, ১৭৯৪-১৮৫৫)। তিনি পাশ্চাত্যের সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন মুখ্যত বর্বরদের বিরুদ্ধে বর্বরদের ব্যবহারের জন্য এবং বর্বরদের উন্নত প্রযুক্তি আয়ত্ব করে বর্বরদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।

পাশ্চাত্য ধাঁচের সামরিক বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে টিয়েন্টসিনে কয়েকশো চীনা সৈন্যের উন্নত সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় যা পিকিং ফিল্ড ফোর্স নামে পরিচিত। যুবরাজ কুং এবং চীন সামরিক পরিষদের সদস্য ওয়েন-সিয়াং (Wen hsiang) এই সেনা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮৬২-তে রুশ সরকারের চীনকে দেওয়া সমর উপকরণ দিয়ে পিকিং ফিল্ড ফোর্সকে সংগঠিত করা হয়। সামরিক শক্তিবৃদ্ধির অঙ্গহিসাবে আগ্নেয়াস্ত্র ও কামানবাহী গান বোটের ব্যবহারের কথা বলা হয় এবং সেগুলি যাতে চীনে প্রস্তুত করা যায় সে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়।

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে সেং কুয়ো ফ্যান আনকিং-এ (Anging) একটি আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নির্মাণের কারখানা স্থাপন করেন। দৈহিক শ্রমের ওপরে নির্ভরশীল এই কারখানায় কার্তুজ ও গোলাবারুদ তৈরী হত। এছাড়া এখানে একটি বাষ্পচালিত নৌকা (Steam Boat) তৈরী করা হয়। আত্মশক্তি বৃদ্ধির মুখ্য পরিকল্পনাগুলি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সেং কুয়ো ফ্যান (Tseng Kuo-Fan), সো সুং-টাং (Tso Tsung Tang) এবং লি হাং চ্যাং-এর মত প্রাদেশিক নেতাদের ভূমিকাই ছিল বেশি। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে লিং হাং চ্যাং সাংহাইতে একটি গোলাবারুদ নির্মাণের কারখানা খোলেন যার মূখ্য প্রশাসক ছিলেন হ্যাল্লিডে ম্যাকার্টনে (Halliday Macartney) নামক এক ইংরেজ। ঐ বছরে যুবরাজ কুং-এর প্রস্তাব অনুযায়ী পিকিং-এ বিদেশী ভাষা শিক্ষার কলেজ তুংওয়েন কুয়ান স্থাপন করা হয় যার মাধ্যমে বিদেশীদের সঙ্গে চীনাদের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। 

১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে সুচাও (Soochow) তে সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদের একটি কারখানা গড়ে তোলেন লি-হাং চ্যাং। ১৮৬৫-তে লি হাং চ্যাং-এর সমরাস্ত্রের কারখানা সাংহাইতে বিদেশিদের নির্মিত সমরাস্ত্র কারখানার সঙ্গে মিলিত হয়। এখানেই চীনাদের দ্বারা নির্মিত প্রথম বৃহৎ বাষ্প জাহাজ তৈরী হয়। এর অল্প কিছুদিন পরে লি হাং চ্যাং তার সুচাওয়ের অস্ত্র কারখানা নানকিং-এ স্থানান্তরিত করেন। সেং কুয়ো ফ্যানের উদ্যোগে ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে সাংহাইতে কিয়াংনান অস্ত্রাগার নির্মাণ করা হয়। এই সমরাস্ত্রের কারখানায় শুধু বন্দুক ও কামান তৈরী হত না জাহাজও তৈরী হত। তাছাড়া এখানে একটি অনুবাদ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়। এই কারখানা থেকেই পাঁচটি জাহাজ তৈরী হয়। এখানকার অনুবাদ কার্যালয় দশ বছরেরও কম সময়ে ৯৮টি পাশ্চাত্য গ্রন্থের অনুবাদ সম্পূর্ণ করে যার মধ্যে ৪৭টির বিষয়বস্তু ছিল প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং ৪৫টি বিষয় ছিল সামরিক ও প্রযুক্তি।

সেং কুয়ো ফ্যান পাশ্চাত্তায়নের যে ধারার সূচনা করেন সো সুং তাং ও লি হাং চ্যাং তাকে এগিয়ে নিয়ে যান। জ্ঞান ও কর্মের ঐক্যে বিশ্বাসী সো’র চিন্তাধারা ছিল লিন সে সু (Lin Tse Hsu) এবং ওয়েই ইউয়ান (Weu Yuian)-এর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। জাহাজ নির্মাণ শিল্পে তাঁর আগ্রহ থেকেই ১৮৬৬তে জন্ম হয় ফুচাও (Foochow) পোতাঙ্গনের। এখান থেকে চল্লিশটি (৪০টি) জাহাজ তৈরী হয়। এর নৌ বিদ্যালয়  থেকেই য়েন ফু (Yen Fu)-র মত দক্ষ অফিসার তৈরী হয়। ফুচাও পোতাঙ্গনকে তাই আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্মারক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। সমরাস্ত্র নির্মাণ ও জাহাজ তৈরীর পাশাপাশি পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ ও পুস্তিকার অনুবাদ ছিল আত্মশক্তি বিকাশের অন্যতম অঙ্গ। এই ধারাকে অনুসরণ করেই পরবর্তী দশকগুলিতে প্রধানত ইংরেজ ডান ফ্রায়ারের নেতৃত্বে ১৭৩টি গ্রন্থ চীনা ভাষায় অনূদিত অথবা সঙ্কলিত হয়েছিল। আত্মশক্তি বৃদ্ধির উপরোক্ত পদক্ষেপগুলির বেশির ভাগই পিকিং-এ প্রতিষ্ঠিত সুংলি ইয়েমেনের নেতৃত্বে সম্পন্ন হয়েছিল।

১৮৬১-তে প্রতিষ্ঠিত সুংলি ইয়েমেন নামক বৈদেশিক কার্যালয়ের কোন সাংবিধানিক ভিত্তি না থাকলেও চীনাদের সঙ্গে বিদেশীদের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। বস্তুত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পাশ্চাত্য প্রযুক্তি, বিজ্ঞান চর্চা, শিল্পায়ন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মত আধুনিক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল এই সংস্থা। পাশ্চাত্য প্রভাবের সাড়া হিসেবে সুংলি ইয়েমেন ছিল চীনের প্রাতিষ্ঠানিক অভিনবত্বের প্রথম ব্যাপক প্রকাশ। তাই চীনের আত্মশক্তিবৃদ্ধির আন্দোলনে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

এ কথা ভুললে চলবে না যে পাশ্চাত্য প্রভাবে সাড়া দিয়ে আধুনিকতার প্রতি অগ্রসর হওয়ার অর্থ ছিল চীনের চিরাচরিত রাজনীতির ও কনফুসীয় ভাবধারার উন্নজ্ঞান বা ব্যতিক্রমী প্রয়াস। বৈদেশিক সাহায্যে চীনের আত্মশক্তি বিকাশের অর্থ হল কনফুসীয় নৈতিক উৎকর্ষ অপেক্ষা সম্পদ ও শক্তির উৎকর্ষতাকে মেনে নেওয়া। সামরিক শক্তিতে হীনবল হওয়ার জন্য এবং পাশ্চাত্য শক্তির কাছে বারে বারে পরাজয় বরণ করার জন্য, সর্বোপরি দেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহ দমনের জন্য পাশ্চাত্য সমরাস্ত্রের ও প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া একান্ত প্রয়োজন হয়ে দেখা দিয়েছিল। এতদ্‌সত্ত্বেও চিং রাজদরবার রক্ষণশীল কনফুসীয় ভাবধারা রক্ষায় সদা সক্রিয় ছিল।

১৮৬০-৭০-এর দশকের ওয়াং তাংহে (Wang Tonghe) চীনে রক্ষণশীল ভাবধারার প্রতিনিধি ছিলেন, যদিও পরবর্তীকালে তিনি ১৮৯৮-র সংস্কারে আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে ছিলেন। তবে এই সময় রক্ষণশীল ভাবধারার অন্যতম প্রতিভূ ছিলেন ও রেন (Wo Ren)। জাতিতে মোঙ্গল ও রেন (Wo Ren) তাঁর নিম্ন পদমর্যাদাকালীন অবস্থায় দেশে কনফুসীয় ভাবধারা পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন যার মূল বক্তব্য ছিল প্রশাসনিক পদে আধিকারিকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতার পরিবর্তে নৈতিক উৎকর্ষতার ওপর জোর দেওয়া উচিত। এই ধরনের রক্ষণশীল আন্দোলনের ফলে চীনে আধুনিকতার গতি ব্যাহত হয়। জ্যাক গ্রে (Jack Gray) মনে করেন চীনের আধুনিকতার পথে প্রধান বাধা অর্থাভাব নয়, অভাব মানব সম্পদের। চিং সরকার সমুদ্র বাণিজ্য শুল্ক (Imperial Maritime Customs) সংগঠনের মাধ্যমে যে প্রভূত রাজস্ব আদায় করেছিল তা প্রদেশগুলির বিভিন্ন বিকাশ পরিকল্পনায় ব্যয়িত হয়। তবুও ১৮৬৬ থেকে ১৮৯৪-এর মধ্যে চীনের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের শিল্পের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ পর্যাপ্ত ছিল না। সুতরাং রাষ্ট্রীয় শিল্প বিকাশের প্রশস্ত ক্ষেত্র উন্মুক্ত ছিল। রাষ্ট্রীয় শিল্প বিকাশের এই পরিকল্পনাগুলি সফল হলে এবং তার সঙ্গে চীনের ব্যক্তিগত বিনিয়োগ যুক্ত হলে চীনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেই জাপানের মত আত্মনির্ভর শিল্পের বিকাশ ঘটত। 

১৮৬০-এর দশকে আত্মশক্তি বিকাশের বিশেষত্ব হল এর সামরিক চরিত্র। এই সময় চীনা সরকার পাশ্চাত্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করে। এই পরিকল্পনার মধ্যে সমরাস্ত্রের কারখানা নির্মাণ, জাহাজ নির্মাণ, সামরিক স্কুল স্থাপন, দুর্গ নির্মাণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক গ্রন্থের অনুবাদ এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে ছাত্র প্রেরণ সবই ছিল। চীনা সরকার ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার জন্য তাদের আমেরিকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে। মূলতঃ সেং কুয়ো ফ্যান এবং লি হাং চ্যাং-এর প্রচেষ্টায় আমেরিকার হার্টফোর্ড ৩০ জন ছাত্রকে শিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল।

১২০ জন চীনা ছাত্রের এরকম দলকে ১৮৭২ থেকে ১৮৮১-র মধ্যে চার দফায় পাঠানো হয়েছিল। লি জার্মানীতে শিক্ষাগ্রহণের জন্য আধিকারিকদের পাঠান। ঐ সময়েই লি কয়লা ও লৌহ খনি খননের জন্য অনুরোধ জানান। আত্মশক্তি বিকাশের উপরোক্ত প্রয়াসের সবই ছিল সরকারী উদ্যোগে, তাই ব্যবস্থাপনায় ছিল আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা ও সরকারী স্বজন-পোষণ। দ্বিতীয়ত, সমরাস্ত্র নির্মাণে ও প্রয়োগে বিদেশীদের ওপর চীনাদের অতি নির্ভরতা আত্মশক্তি বৃদ্ধির আন্দোলনকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও দুর্বল নেতৃত্বের ফলে চীনের কারখানায় উৎপাদিত বন্দুক ও জাহাজ পাশ্চাত্য গুণমানের সমপর্যায়ভুক্ত ছিল না। তৃতীয়ত, প্রাদেশিক নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে গঠিত সামরিক শিল্প আঞ্চলিক ক্ষমতার ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছিল যার ফলস্বরূপ শক্তিশালী আঞ্চলিক ও সামস্ততান্ত্রিক শক্তির উত্থান ঘটে।

আত্মশক্তি বৃদ্ধির দ্বিতীয় পর্বে বা তুংচি শাসনোত্তর যুগে (১৮৭২-৮৫) সামরিক শক্তিবৃদ্ধির পরিবর্তে সম্পদ বৃদ্ধির ওপরে জোর দেওয়া হয়। সম্পদকেই এই সময় ক্ষমতার উৎস হিসাব চিহ্নিত করা হয়। চিং সরকার বুঝতে পারে প্রথাগত প্রতিরক্ষার খরচের তুলনায় আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার খরচ অনেক বেশি। কেননা আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও শিল্প উদ্যোগের প্রয়োজন হয়। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে লি হাং চ্যাং তাই ঘোষণা করেন: “চীনের দারিদ্রই তার চিরন্তন দুর্বলতার কারণ”। আয়শক্তি বিকাশের দ্বিতীয় পর্বে প্রতিরক্ষা শিল্পের পাশাপাশি লাভজনক শিল্প বিকাশের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল জাহাজ ও রেলওয়ে পরিবহন, খনি শিল্পের বিকাশ এবং টেলিগ্রাফ ব্যবস্থার প্রবর্তন। দ্বিতীয় পর্বের শিল্পোদ্যোগে সরকারী তত্ত্বাবধানের সঙ্গে ব্যক্তিগত মূলধন যোগ হয়। সরকার এর পৃষ্ঠপোষক হলেও লাভক্ষতি সবটাই ছিল বণিকদের বিষয়। এই ধরনের উদ্যোগগুলির মধ্যে অন্যতম f: China Merchants’ Steam Navigation Company, the K’ai-Ping Coal Mines, the Shanghai Cotton Cloth Millet Imperial Telegraph Admin istratio ।

নদ্বিতীয় পর্বের আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের সম্পদ ভিত্তিক আধুনিক শিল্প ও উদ্যোগের অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন লি হাং চ্যাং। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে সেং-এর মৃত্যু হলে এবং সো সুং ভাং চীনের উত্তর-পশ্চিমে মুসলিম বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকার ফলে লি আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতায় রূপান্তরিত হন। বিশেষ করে সম্রাজ্ঞী ভূ-সি কর্তৃক যুবরাজ কুং-এর ক্ষমতা খর্ব করা হলে এবং ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ওয়েন সিয়াং এর মৃত্যু হলে লির উত্থান সহজ হয়। যদিও তিনি একজন প্রাদেশিক নেতা (চিলির গভর্নর জেনারেল) ছিলেন, তবুও তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ সামলাতেন। এটা অবশ্য সম্ভব হয়েছিল তাঁর প্রতি দোয়াগার-জু-সির অগাধ আস্থার জন্য এবং পিকিং এর কাছে তাঁর অবস্থানের জন্য। এই পর্বে আত্মশক্তি বিকাশের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল কাইপিং-এ লৌহ খনি উন্মুক্তকরণ (১৮৭৮), টিয়েন্টসিনে নৌপ্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, টেলিগ্রাফ লাইন স্থাপন, পোর্ট আর্থারে একটি পোতাশ্রয় ও জাহাজ কারখানা স্থাপন (১৮৮২), টিয়েন্টসিনে একটি সামরিক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন (১৮৮৫), পেইয়াং-এ নৌবাহিনী গঠন (১৮৮৮) ইত্যাদি। এগুলি ছাড়া সাংহাইয়ের বণিকেরা একটি সূতীবস্ত্রের মিল স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলনের তৃতীয় পর্বে (১৮৮৫-১৫) সামরিক ও নৌশক্তি বিকাশের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলেও হাল্কা শিল্পের ওপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এর ফলে বস্ত্রশিল্প বিশেষতঃ সুতা ব্যানশিল্পে জোয়ার আসে। এই পর্বের শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে লি হাং চ্যাং-এর আধিপত্য বজায় থাকলেও তাঁকে উহান (Wu-han) এবং নান কিং-এর গভর্নর জেনারেল যথাক্রমে চ্যাং চি তুং (Chang Chi Tung) এবং লিউ-কুন-ই (Liu Kun-i)-র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হয়। ১৮৮৯ সালে চ্যাং কর্তৃক ক্যান্টনে একটি তুলোর মিল এবং লৌহ কারখানা খোলা হয়। একইভাবে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি তা- ইয়েতে লৌহগনি, হ্যান-ইয়াং-এ লৌহ কারখানা এবং পিং সিয়াং-এ কয়লার খনি খোলেন। ১৮৯১ সালে লি হাং চাং লুচাং-এ কাগজের মিল এবং বণিকদের সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিতভাবে কিয়েওচাও লৌহ কারখানা খোলেন। সরকার ও বণিকদের মিলিত প্রয়াসে ১৮৯৪ সালে হপে (Hupeh) প্রদেশে দেশলাই উৎপাদনের জন্য দুটি কোম্পানী গঠন করা হয়। একই ধরনের প্রয়াস কিছু অন্য প্রাদেশিক নেতাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *