চীনের ইতিহাসে মাও সে তুং এর অবদান আলোচনা করো ।
বিশ্বের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে মাও সে-তুং (১৮৯৩-১৯৭৬) হলেন একজন স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগ হল তুলনাহীন। হুনান প্রদেশের এক গ্রামে মাওয়ের জন্ম হয়। এক সচ্ছল কৃষক পরিবারের সন্তান মাও শৈশবে গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া শেখেন, পিতা তাঁকে উচ্চশিক্ষা দিতে চাননি, মাও উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় হুনানের সদর কার্যালয় চ্যাংসায় আসেন, উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। শৈশবে ও কৈশোরে তিনি গুপ্ত সমিতির সদস্যদের সঙ্গে পরিচিত হন।
দেশের দুর্দশা তাঁকে ব্যথিত করত। তিনি চিনের গ্রামাঞ্চলে জেন্ট্রিশ্রেণীর সামন্ততান্ত্রিক শোষণ দেখেছিলেন। চিনের ওপর বিদেশি আগ্রাসন চলেছিল, পশ্চিমি পুঁজির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। কৈশোরে তিনি দেশের মুক্তির কথা ভেবেছিলেন। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গ্রন্থাগারিক লি-তা-চাও তাঁকে মার্কসবাদে দীক্ষা দেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে সাংহাই শহরে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হলে তিনি হুনান প্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। যৌবনে তিনি হুনান প্রদেশের কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠন গড়ে তোলার কাজে মন দেন।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টির সদর দপ্তর সাংহাই থেকে কিয়াংসিতে সরিয়ে আনা হয়। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কুয়োমিনটাং বাহিনী কিয়াংসি আক্রমণ করলে মাওয়ের নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা কিয়াংসি ছেড়ে শেনসির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিল। ১৯৩৪ থেকে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লাল ফৌজ এগারোটি প্রদেশ অতিক্রম করে শেনসিতে এসে পৌঁছেছিল। মাও এই লং মার্চের সময় শ্রমিক, কৃষক, পাতিবুর্জোয়া ও জাতীয় বুর্জোয়াদের নিয়ে জাতীয় বিপ্লবী ফ্রন্ট গঠনের কথা বলেন।
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ইয়েনানে কমিউনিস্টদের নতুন ঘাঁটি গড়ে ওঠে, এখানে প্রথম সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছিল। মাও কৃষক শ্রেণীর সমর্থন লাভ করেন, তাদের নিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করেন। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে এডগার স্নো ও তাঁর স্ত্রী মাওয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে লেখেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ রেড স্টার ওভার চায়না (Red Star Over China) 1 লং, মার্চের সময় থেকে মাও কমিউনিস্ট দল ও সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব লাভ করেন। চিনের অনেক কমিউনিস্ট নেতা তাঁর বিরোধী ছিলেন, কমিন্টার্ন সমর্থিত ২৮ জন কমিউনিস্ট নেতা মাও বিরোধী গোষ্ঠী গঠন করেছিল। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্যির সম্মেলনে মাওকে পলিটব্যুরোর চেয়ারম্যান ও সামরিক পরিষদের প্রধান নিযুক্ত করা হয়। সুন্যির সম্মেলনে জাপান বিরোধী সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মাও-এর চিন্তাভাবনায় জাতীয়তাবাদ ও সাম্যবাদী আদর্শের মিশ্রণ ঘটেছিল। জাপানি আগ্রাসন এবং কুয়োমিনটাং দলের ব্যর্থতা মাওকে চিন বিপ্লবে নেতৃত্ব গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছিল। সান-ইয়াৎ-সেনের আদর্শ থেকে জাতীয়তাবাদী কুয়োমিনটাং বিচ্যুত হয়েছিল, কৃষি অর্থনীতির সংস্কারের দিকে তারা না দেয়নি। মাও কৃষিপ্রধান চিনের কৃষকদের বিপ্লবী সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করে বিপ্লবের কাজে লাগিয়েছিলেন।
মাও সে-তুং হলেন একাধারে কবি, বিপ্লবী, রাষ্ট্রনেতা ও সংগঠক। বিপ্লবের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তাঁর লেখাতে পাওয়া যায়। অ্যানালিসিস অব ক্লাসেস ইন চাইনিজ সোসাইটিতে (Analysis of Classes in Chinese Society) তিনি চিনা সমাজের ব্যাখ্যা করেছেন। রিপোর্ট অব এ্যান ইনভেস্টিগেশন ইনটু দ্য পেজান্ট মুভমেন্ট ইন হুনান (Report of an Investigation into the Peasant Movement in Hunan) গ্রন্থে তিনি দরিদ্র কৃষকদের বিপ্লবের চালিকা-শক্তি রূপে চিহ্নিত করেন। তিনি লিখেছেন অন দ্য ট্যাকসিক্স অব ফাইটিং জাপানিজ ইম্পিরিয়ালিজম (On the tactics of fighting Japanese imperialism) এবং স্ট্র্যাটেজিক প্রবলেম্স ইন চায়নাজ রেভোলুশনারি ওয়ার (Strategic problems in China’s revolutionary war)।
জাপানের বিরুদ্ধে কী রণকৌশল অনুসরণ করা যেতে পারে মাও তার বিস্তৃত বিবরণ রেখেছেন। দুটি তাত্ত্বিক রচনা হল অন কন্ট্রাডিকশন (On Contradiction) এবং অন প্রাকটিস (On Practice)। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত নিউ ডেমোক্রেসি (New Democracy), যুক্তফ্রন্ট ও কোয়ালিশন সরকারের কথা এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে লেখেন দ্য প্রেজেন্ট সিচুয়েশন অ্যান্ড আওয়ার টা (The present situation and our tasks)। রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবিলায় সামরিক শক্তির গুরুত্বের কথা তিনি বিশ্লেষণ করেছেন, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের কথা তিনি বলেছেন (on protracted war)। গ্রামাঞ্চল থেকে গেরিলা বাহিনী শহর ঘিরে ফেলে ক্ষমতা দখল করবে, এই ছিল তাঁর রণকৌশল।
১৯৩৬-৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলি লেখা হয়। তাঁর চিন্তাভাবনা দানা বেঁধে উঠেছিল, ইয়েনান পর্বে মাওবাদের উদ্ভব হয়। মার্কসবাদের তত্ত্ব অনুযায়ী সামাজিক বা অর্থনৈতিক স্তরের বিকাশের ওপর চিনের বিপ্লব নির্ভরশীল নয়, বিপ্লবী চেতনার অগ্রগতির ওপর বিপ্লব নির্ভর করবে। এখানে তিনি মৌল চিস্তার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি মনে করেন আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জাতীয় সংগ্রাম সংগতিপূর্ণ। চিনের জনগণ, শুধু প্রোলিতারিয়েত নয়, বিপ্লবের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে। ভূমিসংস্কার করে তিনি কৃষকদের সমর্থন লাভ করেন, ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী ও বুর্জোয়ারা কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়। কুয়োমিনটাং দলের সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে তিনি জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে কুয়োমিনটাং সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে তিনি ক্ষমতা দখল করেন। চিনে গণপ্রজাতন্ত্র স্থাপিত হয় (১৯৪৯), বিপ্লব সাফল্যমণ্ডিত হয়।
মাও সে-তুং হলেন একজন বিপ্লবী নেতা, গণপ্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং চিনে সমাজতন্ত্রের প্রবর্তক (a revolutionary leader, founder of the people’s republic, and pioneer of socialist cause in China)। মাওয়ের মূল্যায়নে তাঁর ত্রুটিগুলির কথাও উল্লেখ করা প্রয়োজন। তাঁর প্রধান ত্রুটি হল তিনি চিনে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে দেননি, ৩০ বছরের মধ্যে জনসংখ্যা ৫০০ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ১০০০ মিলিয়নে পরিণত হয়। সোভিয়েত মডেল অনুসরণ করে তিনি শিল্পায়নের ওপর বেশি গুরুত্ব দেন, কৃষি অগ্রাধিকার পায়নি। এরফলে চিনে খাদ্যাভাব দেখা দেয়, বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করে ঘাটতি মেটানো হয়।
কৃষির উন্নতি ও জন্মনিয়ন্ত্রণের ওপর চিনের অগ্রগতি যে নির্ভরশীল এই ধারণা তাঁর ছিল না (Mao’s population and agricultural policies had created the most serious obstacles to rapid modernization)। মাওয়ের দ্বিতীয় ভুল হল তিনি বিশ বছর ধরে চিনকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ করে রেখেছিলেন (China had been virtually cut off from the outside world for twenty years)। এই সময়ে পশ্চিমি দেশ ও জাপানে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি হয় চিন তার কোনো সুযোগ নিতে পারেনি। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও শ্রেণী সংগ্রাম নিয়ে চিন বিব্রত ছিল। তাঁর তৃতীয় ভুল হল অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বামপন্থী দুঃসাহসী পদক্ষেপের সমর্থন (leftist blind actionism)। দ্রুত সমৃদ্ধির আশায় এমন সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল যা চিনের পক্ষে মঙ্গলজনক হয়নি। এমন সব লক্ষ্য ধার্য করা হয় যা বাস্তবায়িত করা সম্ভব ছিল না। মাওয়ের চতুর্থ ভুল হল দলের মধ্যে একাধিপত্য স্থাপন, মাও হলেন দল, সরকার ও সৈন্যবাহিনীর প্রধান। প্রদেশ ও জেলাস্তরে মাওকে অনুকরণ করে নেতারা একাধিপত্য স্থাপন করেছিল।
১৯৬৬-৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি নিজেই নিজের সরকারের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করেন। যৌথ নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকরণের নীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সংশোধনবাদী প্রবণতা, পুঁজিবাদ, দুর্নীতি, অপচয় ও আমলাতান্ত্রিকতা দমন করার জন্য সাংস্কৃতিক বিপ্লব হলেও এর আতিশয্য যে বিপ্লবের ক্ষতি করেছিল মাও তা স্বীকার করে নেন। কমিউনিস্ট দল পরবর্তীকালে এর সমালোচনা করেছিল। পশ্চিমের নেতারা কেউ কেউ তার সমালোচনা করেন, পশ্চিমি ঐতিহাসিকরা তার মধ্যে ক্ষমতা লিপ্সা ও স্বৈরাচারী প্রবণতা লক্ষ করেছেন। জন হ্যালিডে বলেছেন, মাও ছিলেন ক্ষমতালোভী, স্বৈরাচারী। চিনের কমিউনিস্ট পার্টি তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর যে মূল্যায়ন করেছিল তাতে বলা হয়েছে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক, ৩০ শতাংশ সিদ্ধান্ত ছিল ভুল। এসব সত্ত্বেও বলা যায় বর্তমান চিন প্রজাতন্ত্রে তাঁর ভাবমূর্তি আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে।
মাওয়ের সবচেয়ে বড়ো অবদান হল তিনি মার্কসবাদের সঙ্গে চিনের বৈপ্লবিক পরিস্থিতির সামঞ্জস্য ঘটিয়ে এক নতুন ধারা প্রবর্তন করেন (He creatively integrated Marxist universal principles with concrete Chinese revolutionary conditions to form a new synthesis that suited the Chinese situation)। অস্বীকার করা যায় না মাও সে-তুং বিপ্লবী নেতা হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত সফল কিন্তু জাতির সংগঠক হিসেবে কিছু ভুলভ্রান্তি করে ফেলেছিলেন (Mao was extremely successful as a revolutionary but disappointingly erratic as a nation builder)। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ছিলেন আদর্শ অনুকরণযোগ্য নেতা, পরবর্তীকালের ভুলভ্রান্তির জন্য তিনি খানিকটা মর্যাদা ও সম্মান হারিয়েছিলেন। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও চিনের বিপ্লবের ইতিহাসে তিনি আজও উজ্জ্বল তারকা হিসেবে বিরাজ করছেন।
মাও সে-তুং হলেন আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠলেন পূর্ব দিগন্তের লাল সূর্য। বিচক্ষণ রাষ্ট্রনেতা, ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন কূটনীতিবিদ, প্রশাসক ও সামরিক নেতা তাঁর সহকর্মীদের সমর্থন ও আনুগত্য পেয়েছিলেন। এদের অবিচল আস্থা ও আনুগত্য না পেলে তিনি একজন মহান নেতা হয়ে উঠতে পারতেন না। এই বিপ্লবী নেতা সশস্ত্র প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছেন কিন্তু অত্যাবশ্যক রক্তপাতে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। তাঁর মতামতের বিরোধীদের তিনি বন্দি করেছেন কিন্তু হত্যা করেননি। যাদের তিনি আদর্শচ্যুত বলে মনে করেছেন তাদের তিনি কায়িক শ্রম ও পড়াশোনার মাধ্যমে শোধরানোর সুযোগ করে দিয়েছেন। অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করা হলে মাও তার নিন্দা করতে দ্বিধা করতেন না।
চিনের কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি তাঁর বিরোধিতা করেছেন, তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা করেছেন মাও এদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেননি। তাঁর আত্মপ্রতিষ্ঠার এবং আত্মরক্ষার অস্ত্র ছিল মার্কসবাদ ও আলাপ-আলোচনা। কুয়োমিনটাং সৈন্যবাহিনীর বহু অফিসার ও সৈন্যের প্রতি যাও মানবিক ব্যবহার করেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে তথাকথিত দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবীদের বিরুদ্ধে মাও শ্রমের মাধ্যমে শিক্ষাদানের নীতি অনুসরণ করেন। অনেকে তখন প্রতিবিপ্লবী বা শ্রেণীশত্রুরূপে চিহ্নিত হলেও তিনি তাদের জীবনহানি চাননি। সোভিয়েত রাশিয়ার দুর্ধর্ষ বেরিয়ারের জীবন রক্ষার জন্য তিনি সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের কাছে আবেদন রেখেছিলেন। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় লিউ-শাওচি থেকে ছোটো-বড়ো অনেক নেতা সংগ্রামের লক্ষ্য হয়েছিলেন, কিন্তু মাও এদের প্রাণনাশের কথা ভাবেননি।
সারাজীবন মাও সে-তুং অটল প্রতিজ্ঞা নিয়ে বিপদের সামনে দাঁড়িয়েছেন। নিজের শক্তির ওপর তাঁর ছিল পূর্ণ আস্থা। বিপদের মোকাবিলায় কী ব্যবস্থা নিতে হবে তা তিনি আগে থেকে ঠিক করে নিতেন। তাঁর ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাস দেখে সহকর্মীরা বিস্মিত হতেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে কুয়োমিনটাং বাহিনী ইয়েনান আক্রমণ করলে মাও মোটেই বিচলিত হননি। ইয়েনান ত্যাগ করে তিনি অন্যত্র চলে যাননি যদিও সহকর্মীরা তাঁকে বারবার সে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। মাও সে-তুং ছিলেন একজন জনদরদি মানুষ, চিনের জনগণকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলেন, তারাও তাঁকে ভালোবেসেছিল। তিনি মাঝে মাঝে গ্রামের কৃষকের বাড়িতে চলে যেতেন, তাদের সঙ্গে সময় কাটাতেন, তাদের সুখ-দুঃখের খবর নিতেন, সাধ্যমতো তাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করার চেষ্টা করতেন।
‘মাও সর্বদা জনগণের মধ্যে চলাফেরা করেছেন, তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাদের সুখ-দুঃখে সাথী হয়েছেন, নিজের ব্রত ও আদর্শ পালনে তাদের সমর্থন কামনা করেছেন। মূক জনগণকে কখনও তিনি মূর্খ বলে মনে করেননি। তাঁর মতে, জনগণ হলেন বিশ্ব ইতিহাসের চালিকা শক্তি। তাঁর বক্তব্য ছিল জনগণের মতামত নিয়ে নীতি তৈরি করে জনগণের সহযোগিতায় তা কার্যকর করতে হবে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে চিনে খাদ্যাভাব দেখা দিলে মাও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন, গ্রামের সঠিক চিত্র জানার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। গণ-কমিউন ও সার্বজনীন ভোজনাগার সম্পর্কে জনগণ কী ভাবছে তা জানার জন্য তিনি আগ্রহী ছিলেন। জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য তিনি সর্বাত্মক প্রয়াস চালানোর আবেদন জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেনঃ “সর্বব্যাপী প্রয়াস চালাতে হবে, উচ্চ লক্ষ্য নিতে হবে, পনেরো বছরের মধ্যে ইংল্যান্ডের সমান হতে হবে।
মূল্যায়ন :
মাও সে-তুং ছিলেন একজন কবি, শিল্পী, দরদি মানুষ। মানুষের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা সীমাহীন সহানুভূতি। চিনের মানুষকে তিনি ভালোবেসেছিলেন, তাদের মুক্তি দিয়েছিলেন দু’হাজার বছরের দাসত্ব থেকে। আত্মম্ভরিতা তাঁর ছিল না, ছিল কবির মতো উদার স্বভাব।