পোর্টসমাউথের চুক্তির তাৎপর্য
রাশিয়া অপ্রত্যাশিতভাবে প্রাচ্যের বামন দ্বীপরাষ্ট্র জাপানের কাছে পরাজিত হয়। মুকদেন ও পোর্ট আর্থার বন্দর জাপানের হস্তগত হয়। লিয়াও টাং-এর যুদ্ধেও জাপান জয়ী হয়। ১৯০৫-এর ২৭শে মে শুসিমা ( Tshusima) প্রণালীতে জাপানী অ্যাডমিরাল টোগো (Togo) এবং রুশ অ্যাডমিরাল রডজেস্ট ভেন্সকি (Rodjest vensky) -এর মধ্যে প্রবল জলযুদ্ধের পর জাপান জয়লাভ করে। এই জলযুদ্ধে রাশিয়ার ৩২টি জাহাজ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ই মে পোর্টসমাউথের সন্ধি স্বাক্ষরের মাধ্যমে রুশ-জাপান যুদ্ধের অবসান ঘটে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টের সহায়তায় ও মধ্যস্থতায় জাপান ও রাশিয়ার মধ্যে পোর্টস মাউথের সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
পোর্টস মাউথের সন্ধির প্রধান শর্তাদি হল: (১) রাশিয়া কোরিয়াতে জাপানের রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক স্থায়ী স্বার্থের স্বীকৃতি দেয়। (২) রাশিয়া জাপানকে লিয়াওটাং উপদ্বীপ ও পোর্ট আর্থারের বরফমুক্ত পোতাশ্রয়ের ইজারা ছেড়ে দেয়। (৩) রাশিয়া পোর্ট আর্থার পর্যন্ত দক্ষিণ রেলের অংশ জাপানকে সমর্পণ করে। (৪) রাশিয়া ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে অধিকৃত সাখালিনের দক্ষিণাংশ (এর কয়লা ও পেট্রোলিয়াম সম্পদ সহ) জাপানকে অর্পণ করে। (৫) রাশিয়া ও জাপান প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে তারা উভয়েই মাঞ্চুরিয়া থেকে সৈন্য অপসারণ করে নেবে এবং মাঞ্চুরিয়া চীনকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। (৬) এই যুদ্ধবাবদ রাশিয়া জাপানকে কোন ক্ষতিপূরণ দেবে না। (৭) রাশিয়া ও জাপান উভয় দেশ-ই মাঞ্চুরিয়ায় তাদের রেল, শিল্প ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ছাড়া রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
জলে স্থলে উভয় যুদ্ধেই জাপান জয়লাভ করার পর পোর্টস মাউথের সন্ধিতে কোন ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় জাপানে জনরোষ বৃদ্ধি পায়। রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপান জয়লাভ করলেও তাকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মকালে জাপান আর্থিক ও সামরিক শক্তির দিক থেকে বিধ্বস্ত ছিল। চীন-জাপান যুদ্ধের তুলনায় রুশ জাপান যুদ্ধ সংক্ষিপ্ত হলেও প্রচুর সেনাহানি ঘটে। পোর্ট আর্থারে-ই ৬০ হাজার জাপানী সেনা হত হয়, মুকদেনের যুদ্ধে ৪০ হাজারের বেশি জাপানী সেনা প্রাণ হারায়। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ২০৩ মিটার হিল দখল করতে গিয়ে আরো দশ হাজার সেনা প্রাণ হারায়। এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির কথা মাথায় রেখে মাঞ্চুরিয়ায় হাই কম্যান্ড হিসেব করেন যে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য আরো হাজার মিলিয়ন ইয়েন এবং ২৫ মিলিয়ন সেনা প্রয়োজন। চরম জাতীয়তাবাদীদের প্ররোচনায় টোকিওর জনতা কাতসুরা ক্যাবিনিটের বিরুদ্ধে দাঙ্গা বাধায়। এই দাঙ্গা থামাতে সামরিক শাসন জারি করতে হয়। আমেরিকায় সন্ধি প্রস্তাব স্বাক্ষর করে জাপানের বিদেশমন্ত্রী কোমুরা (Komura) গোপনে দেশে ফেরেন, কারণ আততায়ীর দ্বারা খুন হবার সম্ভাবনা তাঁর ছিল। এর থেকে সহজেই অনুমান করা যায় কি গভীর বিদ্বেষ দেশে জমা হয়েছিল।
কোরিয়া প্রসঙ্গে রিচার্ড স্টোরী বলেন যে যুদ্ধ শেষ হবার আগেই জাপান সেখানে তার নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করে। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে কোরিয়া জাপানের আর্থিক ও কূটনৈতিক পরামর্শদাতাদের গ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং কোরিয়াতে জাপানের অবস্থা অনেকটা মিশরে গ্রেট ব্রিটেন এবং মরক্কোয় ফ্রান্সের মত হয়। ১৯০৫-এ ইটোর নেতৃত্বে কোরিয়ার রাজার কাছে একটি বিশেষ মিশন পাঠিয়ে একটি সন্ধি স্বাক্ষরের জন্য প্রণোদিত করা হয়, যাতে কোরিয়ার বৈদেশিক বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ জাপানী রেসিডেন্ট-জেনারলের কাছে অর্পিত হয় এবং ইটোকে এই গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করা হয়। কোরিও রাজদরবার ও সরকার জাপানীদের দ্বারা আরো স্বাধীনতা হরণের তীব্র বিরোধিতা করে জাপানী পরামর্শদাতাদের সঙ্গে আন্তরিক সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হয়। ফলে ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ইটো কোরিয়ার রাজার কাছে আরো নতুন দাবি পেশ করে যাতে পরামর্শদাতাদের হাতে কার্যনির্বাহী ও আইন বিভাগীয় ক্ষমতা অর্পণের কথা বলা হয়। এই চরম অপমানজনক প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে পদত্যাগ করাকেই তিনি শ্রেয় মনে করেন।
যুবরাজ ই (yi) রাজার স্থলাভিষিক্ত হয়ে জাপানী চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। এইভাবে কোরিয়া কার্যত জাপানের উপনিবেশে পরিণত হয়। ইয়ামাগাতা কোরিয়াকে জাপানী রাজ্যভুক্ত করতে চাইলেও ইটো স্বরাজ্যভুক্তিকরণের বিরোধিতা করেন। যাইহোক, কাৎসুরা সরকারের দ্বিতীয় প্রশাসনিক কালে ইটোর ক্ষমতা হ্রাস এবং সামরিক প্রশাসকদের নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তীভাগে মাঞ্চুরিয়া যাওয়ার পথে ইটো হারবিন স্টেশনে এক আততায়ীর দ্বারা নিহত হন। ইটোর হত্যা-ই ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে জাপান কর্তৃক কোরিয়া গ্রাসের সুযোগ নিয়ে আসে।
১৯১০ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে কোরিয়া জাপান সাম্রাজ্যভুক্ত হয় এবং কোরিয়ার যুবা রাজা ই (I)-কে প্রয়োজনীয় ভাতা প্রদান করা হয়। কোরিয়ার রাজবংশকে মেজী সম্রাটের পরিবারের সমান মর্যাদা প্রদান করা হয়। এইভাবে কোরিয়ায় ৩৫ বছরের জাপানী শাসন শুরু হয়। রুশ-জাপান যুদ্ধে জয়লাভের ফলে জাপানের আন্তর্জাতিক মর্যাদা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী লালসা। জাপান একটি পূর্ণাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ঐতিহাসিক ফেয়ারব্যাঙ্ক তাই লেখেন : “The immediate result of the Russo-Japanese war was to make Japan a full-fledged imperialist power, not only ruling Taiwan (Formosa), but also dominating Korea and expanding in Manchuria.”
দূরপ্রাচ্যে তাই পাশ্চাত্য সম্প্রসারণবাদীদের সাথে জাপানী সাম্রাজ্যবাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। জঙ্গী জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ জাপানী সাম্রাজ্যবাদ পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের চেয়ে কোন অংশে কম গতিশীল ছিল না। ফেয়ারব্যাঙ্ক মন্তব্য করেন : “এমনকি অতি জাতি সচেতন পাশ্চাত্যবাদীরা তাদের নর্ডিক জাতির শ্রেষ্ঠত্বের কথা বললেও জাপানকে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হিসেবে মানেন।” (Even the most race-minded westerners, though still convinced of Nordic supremacy, had to admit that Japan was an exception). পাশ্চাত্য শক্তির অপরাজেয়তার মিথকে ধূলিসাৎ করে যে জাপানী সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ও আত্মবিশ্বাসের বিজয় পতাকা উড়েছিল সে কথা মাথায় রেখেই ন্যাথানিয়েল পেফার (Nathaniel Peffer) মন্তব্য করেন, “পোর্টস্ মাউথের সন্ধি স্বাক্ষরের দিন থেকেই ঐতিহাসিক মনোভাবাপন্ন যে কোন ব্যক্তি আত্মবিশ্বাসের সাথে এই ভবিষ্যৎবাণী করতে পারতেন যে, এশিয়াতে পাশ্চাত্য শাসনের গোধূলি লগ্ন আসন্ন।” (“On the day the Treaty of Portsmouth was signed the historically minded could have predicted with confidence that the twilight of western rule in Asia had set in).
ফেয়ারব্যাঙ্কের মতে জাপানের বিস্ময়কর বিজয় পূর্ব এশিয়ায় বৃহৎ শক্তি সম্পর্কে স্থিতাবস্থা নিয়ে এসেছিল এবং সেখানে সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বিতার মহাকালের অবসান ‘ঘটিয়েছিল। একই সঙ্গে সেইসব শক্তি পুনরায় ইউরোপে সম্পর্ক রচনায় নিমজ্জিত হয় (“Japan’s spectacular victory stabilized great-power relations in East Asia and ended the high period of imperialist rivalry there, at the same that the powers again became absorbed in their relation in Europe.”) ইতিমধ্যে ১৯০৪-এর এপ্রিলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স আন্তরিক আঁতাত (Entente Cordal) গঠন করে। ১৯০৭ এর জুনে ফ্রান্স ও জাপান এক সন্ধি স্বাক্ষর করে চীনের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতাকে মর্যাদা দিতে সম্মত হয়।
বস্তুত ১৯০০-এর পরে স্বাক্ষরিত সব চুক্তিতেই মুক্তদ্বার নীতি (Open Door policy)-র প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয় এবং এশিয়ায় একে অপরের “অবস্থা ও রাষ্ট্রীয় অধিকার”কে (Situation and territorial rights) সমর্থন করা হয়। কার্যক্ষেত্রে এর অর্থ দাঁড়ায় চিং সাম্রাজ্যাধীন “প্রভাবের ক্ষেত্রের” (Spheres of influence) পারস্পরিক অধিকারের সুরক্ষা। ১৯০৭-এর জুলাই মাসে স্বাক্ষরিত রুশ জাপান কনভেনশনে চীনের স্বাধীনতা ও অখণ্ডতা রক্ষা করার কথা বলা হলেও রাশিয়া ও জাপান গোপনে মাঞ্চুরিয়াকে যথাক্রমে উত্তর ও দক্ষিণ প্রভাবের ক্ষেত্রে ভাগ করে নেয়। ১৯০৭-এর আগস্টে স্বাক্ষরিত ইঙ্গ-রুশ আঁতাতের দ্বারা রুশ-জাপান কনভেনশনের গোপন উদ্দেশ্য ঢাকা পড়ে। কারণ ইঙ্গ-রুশ কনভেনশান এই দুই শক্তির স্বার্থের মেলবন্ধন রচিত হয়েছিল পারস্য, আফগানিস্তান এবং তিব্বতে।
রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপানের জয় চীনাবাসীকে নব প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। তারা পাশ্চাত্য ধাঁচে সংস্কার প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। পাশ্চাত্য শিক্ষা পদ্ধতি ও শিক্ষা বিষয়ে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে চীনা ছাত্ররা বিদেশে পাড়ি দেয়। ইউরোপ ও আমেরিকার পাশাপাশি জাপানেও চীনা ছাত্রদের ভিড় জমে। চীনের পশ্চাৎপদতার জন্য মাঞ্চুবংশকে দায়ী করা হয় এবং ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে সান ইয়াৎ সেনের নেতৃত্বে প্রজাতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত হলে মাঞ্চু বংশের উচ্ছেদ ঘটে। সমগ্র এশিয়াবাসীর কাছে জাপানের এই জয় জাতীয়তাবাদী প্রেরণার উৎস ছিল। শুধু চীনেই নয় ভারত, ফিলিপিনস, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া সর্বত্র জাপানীদের দৃষ্টান্ত আধুনিক স্বদেশপ্রেমীদের পাশ্চাত্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রেরণা জোগায়।
How to download it
Now, I am telling you how to download this article. It's easy to download just follow few easy steps. Just Click on right corner of your browser (3 dot) then click again 3 rd option that is download option. Now your article is downloaded. Thank you for visiting studymamu.in