সাতসুমা বিদ্রোহের উপর একটি ছোট নোট লেখ
মেজি প্রত্যাবর্তনের পর জাপানের নেতারা সামন্ততন্ত্রের অবসানের ওপর জোর দিয়েছিলেন। এরফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কৃষক ও যোদ্ধা সামুরাই শ্রেণী। নতুন ব্যবস্থায় কৃষকদের খাজনা বেড়েছিল, এজন্য তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটেছিল। কৃষকেরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল, তবে এসব অভ্যুত্থান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল না। স্থানীয় অভাব-অভিযোগ দূর করার উদ্দেশ্য নিয়ে কৃষকেরা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ােত। মেজি সংস্কারের ফলে সামুরাই শ্রেণী ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারণ তাদের সংখ্যা খুব বেড়ে গিয়েছিল। এই সময় জাপানে মোট লোকসংখ্যা হল ৩৪ মিলিয়ন, এর মধ্যে সামুরাইদের সংখ্যা হল ১.৭৫ মিলিয়ন।
টোকুগাওয়া যুগে দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ ছিল না, সামুরাইরা শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শাসনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। মেজি যুগের গোড়ার দিকে দেশের শিল্পায়নে এবং শাসন ব্যবস্থায় এই শ্রেণী বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিল। বলা হয় সমগ্র প্রশাসন যন্ত্রটির ওপর সামুরাইদের খুব বেশি প্রভাব ছিল। এই সামুরাইদের মধ্যে থেকে পরবর্তীকালের উদ্যোগী পুঁজিপতি শ্রেণীর আবির্ভাব হয়, জাপানের বণিক শ্রেণী পুঁজিপতিতে রূপান্তরিত হয়নি।
সামুরাইদের অনেকে নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, অনেকে বাণিজ্য ও শিল্পকে আশ্রয় করে সামাজিক প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। কিন্তু এদের বাইরে বিশাল সংখ্যক সামুরাই ছিল যারা নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। প্রত্যাবর্তনের আগে এদের সামাজিক মর্যাদা, উচ্চ বেতন ও ভাতা ছিল। নতুন ব্যবস্থায় তাদের সামান্য পেনশনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, ভদ্রভাবে জীবন যাপনের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। মেজি প্রত্যাবর্তনের অল্প কয়েকবছর পরে তাদের পেনশন বন্ধ করে দিয়ে এককালীন কিছু অর্থ মঞ্জুর করা হয়, এই অর্থও সামুরাই পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য যথেষ্ট ছিল না। মেজি সরকারের বিরুদ্ধে সামুরাইদের আরও অভিযোগ ছিল।
মেজি সরকার নির্দেশ জারি করেছিল যে পুলিশ বা সামরিক বাহিনীর লোক ছাড়া কেউ অস্ত্র বহন করতে পারবে না। সামুরাইরা ঐতিহ্যগতভাবে সঙ্গে তরবারি রাখত, এই অস্ত্র বহনের অধিকার তারা হারিয়েছিল (Samurai grievances exacerbated, further by the decree forbidding anyone other than a policeman or member of the regular armed forces, from carrying a sword)। সামুরাইদের আত্মমর্যাদা প্রচণ্ডভাবে আহত হল যখন সরকার আইন করে সর্বশ্রেণীর মানুষকে সামরিক বাহিনীতে যোগদানের অধিকার দিল। এই অধিকার যুগ যুগ ধরে শুধু সামুরাইরা একচেটিয়াভাবে ভোগ করত (Another blow to Samurai pride was the introduction of conscription, with its implications that any Japanese, however mean his birth, could acquire the martial virtues regarded for centuries as the attribute of a minority privileged class) ।
মেজি যুগের শুরু থেকে সামুরাইদের এসব অভাব-অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিক্ষিপ্তভাবে অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটতে থাকে। এসব অভ্যুত্থানের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ঘটনাটি ঘটেছিল ক্যুসুতে (Kyushu) ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে, এখানে সাতসুমাতে সামুরাই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন সাইগো তাকামোরি। সেই যুগটি নানাকারণে অস্থির ও অশান্ত, পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে নতুন রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলার প্রয়াস চালানো হয়। সাইগো মেজি প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন, মেজি যুগের শুরুতে তিনি অন্যান্য অভিজাতদের সঙ্গে মিলে শাসন পরিচালনা করেছিলেন। তিনি ছিলেন এযুগের একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। টোকিওর উয়েনাতে তাঁর ব্রোঞ্জ মূর্তিটি তাঁর জনপ্রিয়তার সাক্ষ্য বহন করে। সামুরাই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিলেও জাপানিরা আজও তাঁকে মহান সাইগো বলে উল্লেখ করে থাকেন। বিশালদেহী এই মানুষটি ছিলেন মানসিকতায় কঠোর প্রকৃতির, উগ্র জাতীয়তাবাদী। এই বিশিষ্ট নেতা সরকার থেকে পদত্যাগ করে সামুরাই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন, সরকার তাঁকে দেশদ্রোহী বলে ঘোষণা করেছিল।
শোগুনতন্ত্রের পতনের পর পশ্চিমের সাতসুমা, চোষ, হিজেন ও তোষার নেতারা অল্পকিছুকাল ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেছিলেন। কিন্তু মাত্র চার বছরের মধ্যে এদের মধ্যে প্রচণ্ড মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল, এই মতবিরোধের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল কোরিয়া। জাপানের মেজি নেতারা দুর্বল, প্রতিবেশী কোরিয়ার ওপর প্রাধান্য স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু জাপানের সব কূটনৈতিক প্রয়াস ব্যর্থ হয়ে যায়। নড়শ শতকে হিদেযোশির অভিযানের সময় থেকে এই দুই দেশের সম্পর্ক ভালো ছিল না। সাইগো ও তাঁর অনুগামী কয়েকজন উগ্র জাতীয়তাবাদী তা কোরিয়াতে সামরিক অভিযান পাঠানোর প্রস্তাব করেছিলেন। সাইগো নিজে এই অভিযান পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কোরিয়া অভিযানের পক্ষে দুটি যুক্তি ছিল। প্রথমত, পুরোনো ব্যর্থতার প্রতিশোধ নেওয়া হবে, জাতীয় মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে, জাপান কোরিয়া অধিকার করে লাভবান হবে। দ্বিতীয়ত, সামুরাই শ্রেণী নতুন ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট নয়, তাদের কাজ ও মর্যাদার ব্যবস্থা করে অশান্ত, | অস্থির এই সামাজিক শ্রেণীর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।
মেজি সরকারের মধ্যে এই সময় দুটি গোষ্ঠী ছিল, জঙ্গি, উগ্রজাতীয়তাবাদী | নেতৃত্ব দেন সাইগো। অন্য গোষ্ঠীটি ছিল শান্তিবাদী, এই গোষ্ঠীর | নেতৃত্বে ছিলেন চোষু নেতা ইয়ামাগাতা অরিতোমো। তিনি ও তাঁর অনুগামীরা বিদেশ থেকে ফিরে এসে জাপানের পুনর্গঠনের ওপর জোর দেন। কোরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ হলে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করবে এমন সম্ভাবনা ছিল। জাপান এই পর্বে এই ধরনের দুঃসাহসী হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তার ক্ষতি হবে, জাতীয় প্ৰগতি ব্যাহত হবে। শেষপর্যন্ত সরকারের শান্তিবাদী গোষ্ঠীর জয় হয়, সাইগো ও তাঁর অনুগামীরা পদত্যাগ করেন। সাইগো পদত্যাগ করে সাতসুমাতে ফিরে গিয়ে শিক্ষা বিস্তারের কাজে মনোনিবেশ করেন, শিক্ষার পাঠক্রমে তিনি সামরিক শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সরকার থেকে পদত্যাগ করে সাইগো আবার অল্পকালের জন্য সরকারে ফিরে আসেন, কিন্তু অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ দূর হয়নি। সরকারের বিভিন্ন ধরনের সংস্কার তাঁর পছন্দ ছিল না, ঐতিহ্যের খুব বেশি পরিবর্তন তিনি পছন্দ করেননি। তিনি বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষাদান নীতির বিরোধী ছিলেন কারণ তাঁর মনে হয়েছিল এর ফলে জাপানের ঐতিহ্যবাহী সামুরাই শ্রেণীর সর্বনাশ হতে চলেছে। সামুরাই শ্রেণীর লোকেরা সত্তরের দশকের সংস্কার সমূহকে ভালো চোখে দেখেনি। তাদের মনে হয়েছিল অতি অল্প সময়ের মধ্যে অতি দ্রুত খুব বেশি মৌলিক কঠোর সংস্কার প্রবর্তিত হয়েছে (The reform of the 1870s were too drastic or too hastily imposed)।
এই পটভূমিকায় ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে সাইগো তাকামোরির নেতৃত্বে সাতসুমাতে সামুরাইরা বিদ্রোহ করেছিল। সরকারি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন চোষু নেতা ইয়ামাগাতা অরিতোমো। তিনি সাতসুমা বিদ্রোহ দমন করেন, উভয়পক্ষে কমপক্ষে তিরিশ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছিল। আহত সাইগো যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর এক অনুগামীকে তাঁর শিরচ্ছেদ করার আদেশ দেন। সাইগো সামুরাইদের নিয়ে লড়াই করেছিলেন, অপরদিকে সরকারের পক্ষে ছিল নতুন সৈন্যবাহিনী যারা বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক শিক্ষা পেয়েছিল। এই যুদ্ধ জয় করে সরকারি সৈন্যবাহিনী প্রমাণ করেছিল যে কোনো ব্যক্তি যথাযথ শিক্ষা পেলে সামরিক দক্ষতা অর্জন করতে পারে। জাপানের পক্ষে এই সত্যের প্রতিষ্ঠা ছিল সম্ভাবনাপূর্ণ, গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। জাপানি নেতারা এক নতুন শক্তির সন্ধান পেলেন।
সরকার সামুরাইদের খুশি করার জন্য ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ফরমোজায় অভিযান পাঠিয়েছিল, চিন জাপানের সঙ্গে ফরমোজা সংক্রান্ত বিরোধ মিটিয়ে নিয়েছিল। সাতসুমা বিদ্রোহ দমনের পর জাপানি নেতারা প্রথম উপলব্ধি করলেন যে নতুন সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাঁরা চিন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারেন। তাঁদের সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি। সাইগো বলেছিলেন যে তিনি সম্রাটের আদেশের বিরোধিতা করছেন না, তিনি তাঁর ‘দুষ্ট পরামর্শদাতাদের সরানোর প্রয়াস চালাচ্ছেন। জাপানের এই মানসিকতা ছিল অনেক পুরনো, উগ্র জাতীয়তাবাদীরা এই ধারণাকে পোষণ করে হিংসার পথ ধরতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে এই মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছিল। বেতারে সম্রাটের আত্মসমর্পণের নির্দেশ অনেকে তাঁর মন্ত্রীদের কাজ বলে গণ্য করেছিলেন।
মূল্যায়ন:
সাইগোর বিদ্রোহ ছিল পুরোনো সামন্ততন্ত্রের শেষ প্রতিরোধ, বলা যায় সামন্তব্যবস্থার অস্তরাগ। এর অন্য তাৎপর্য হল উগ্র জাতীয়তাবাদী ও জঙ্গিবাদী মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছিল এই বিদ্রোহে। জাপান এই উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে কখনো সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে পারেনি। জাপানের নিয়তির ওপর এর স্থায়ী সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল (Saigo’s rebellion was in one sense the last stand of the old feudal order in Japan, but in so far as was inspired by extreme ultra-nationalist ideas it cast dark shadows forward, far into the future)। আপাতদৃষ্টিতে উজ্জ্বল জাপানের ভবিষ্যতের ওপর কালো ছায়াপাত ঘটেছিল।