মেইজি সরকার গৃহীত সামরিক সংস্কারের উপর টীকা লেখ।
নতুন মেজী সরকারের আধুনিকীকরণের প্রয়াসের প্রথম পদক্ষেপ ছিল সামরিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশের সামরিক শক্তিকে সুদৃঢ় করা। ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে সরকার ও ডাইমিয়োদের মধ্যে স্বাক্ষরিত উদার আর্থিক চুক্তি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সুস্থিতির ফলে সহজেই সামন্ততন্ত্রের উচ্ছেদ সম্ভব হয়েছিল।
১৮৬৮-৬৯ খ্রিস্টাব্দে শোগুনতন্ত্রের উগ্রসমর্থকদের দমন করার মত যথেষ্ট সামরিক শক্তি নতুন সরকারের ছিল। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন এবং বিদেশী শক্তির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার তাগিদে জাপানে দ্রুত সামরিক শক্তির বিকাশ ঘটে। শোগুনতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল হবার সময় নতুন সরকারের সামরিক শক্তি বলতে শুধু স্বেচ্ছাসেবী কিছু সংগঠনের উপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ছিল। তাই সামন্ত-বাহিনী বিশেষ করে পশ্চিমী সাতসুমা ও চোষু গোষ্ঠীর সামরিক সাহায্যের উপর মেজী সরকার নির্ভরশীল ছিল। ওমুরা মাসুজিরো (Omura Masujiro, ১৮২৪-১৮৬৯) নামক চোষু গোষ্ঠীর এক সামুরাই এবং ওলন্দাজ চিকিৎসাবিজ্ঞান ও সামরিক কৌশলের ভূতপূর্ব ছাত্র, নতুন মেজী সরকারের সামরিক বিশেষজ্ঞ রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তিনি অস্ত্রাগার এবং সামরিক অ্যাকাডেমি গড়ে তোলেন, কিন্তু তিনি বাধ্যতামূলক সৈন্যতালিকা ভুক্তির মাধ্যমে ফরাসী আদলের কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে চাইলে রক্ষণশীল গোষ্ঠীর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হন। ওমুরা কিহেইতাই (Kihcitai)-এর শৃঙ্খলা ও নিয়ম মেজী বাহিনীতে আনতে চেয়েছিলেন।
১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে একজন রক্ষণশীল চোষু সামুরাইয়ের হাতে ওযূরা নিহত হন। তার মৃত্যুর পর নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন ইয়ামাগাতা আরিটোমো (Yamagata Aritomo, ১৮৩৮-১৯২২)। নিম্নতম মর্যাদার সামুরাই পরিবারে জন্মেও ইয়ামাগাতা নিজস্ব যোগ্যতাবলে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেন। তিনি যোসিদা সোইন (Yoshida Shoin)-এর কাছে শিক্ষালাভ করেন এবং চোষু গৃহযুদ্ধে কিহেইতাই (Kiheitai) বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। দেড় বছরের ইউরোপ পরিক্রমা শেষে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে তিনি জাপানে ফিরে আসেন।
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের প্রথমে ফরাসী সামরিক পদ্ধতিতে জাপানী রাজ বাহিনীকে (Goshimpei) গড়ে তোলা হয়। এই বাহিনী সাতসুমা, চোষু এবং টোসার ১০ হাজার সেনা নিয়ে সংগঠিত হয়। ঐ বছরেরই শেষের দিকে সামন্ত জমিদারীর বিলোপ সাধন করা হলে নতুন কেন্দ্রীয় সরকার পূর্বতন সামন্তবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং সমগ্র দেশকে চারটি সেনা সুরক্ষিত জেলায় ভাগ করা হয়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধির জন্য সরকারি নির্দেশ জারি করা হয়। সার্বভৌম বাহিনীর (Imperial Force) নাম পাল্টে সার্বভৌম রাজরক্ষী বাহিনী (Imperial Guards) বা Konoe রাখা হয় এবং ইয়ামাগাতা এর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হন।
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে সামরিক বিভাগের পুনরায় সংস্কার করে সামরিক বিষয়ক মন্ত্রককে সেনা ও নৌ-মন্ত্রকে বিভক্ত করা হয়। নতুন সরকার ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে শোগুনের নৌবাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে এবং ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে সামন্তক্ষেত্র বা জমিদারীর অবসান ঘটলে সামন্ত প্রভুদের নৌজাহাজ ও বাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্থলসেনা সংগঠনে ফরাসী পদ্ধতি অবলম্বন করা হলেও মেজী নৌবাহিনী প্রথম থেকেই ব্রিটিশ নৌবাহিনীর আদলে গড়ে তোলা হয়। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে এনোমোটো (Enomoto), যিনি হক্কাইডোতে শোগুন প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, ক্ষমা করার পর, তিনি নতুন সার্বভৌম নৌবাহিনীর (Imperial Navy) ভাইস অ্যাডমিরাল (Vice admiral) নিযুক্ত হন। কিন্তু নব সংগঠিত নৌবাহিনীর উচ্চ পদাধিকারীদের এক বিরাট অংশকে সাতসুমা নৌবাহিনী থেকে নিযুক্ত করা হয় এবং নৌবাহিনীতে তাদের এই আধিপত্য কয়েক দশক ধরে চলে।
মেজ়ী সরকারের সামরিক সংস্কারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ই জানুয়ারীতে পাশ করা সকল শ্রেণী থেকে বাধ্যতামূলক সৈন্য তালিকাভুক্তির আইন (Conscription law)। এই আইন অতি যত্নসহকারে প্রস্তুত করেছিলেন ইয়ামাগাতা। এই আইনে বলা হয়, যে-কোন সামাজিক প্রেক্ষাপটের সকল শ্রেণীর মানুষ বাধ্যতামূলক তিন বছরের সক্রিয় সামরিক পরিষেবা দান করবে এবং পরে আরো চার বছরের পরিষেবা সংরক্ষিত রাখা হবে। যদিও এক দশক আগে প্রায় এই ধরনের সংস্কারের আভাস সাধারণ স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারা চোষুর মিশ্র সেনা সংগঠনের মধ্যে পাওয়া গেলেও সর্বজনীন বাধ্যতামূলক সেনা সংগঠন এই প্রথম। Reischauer তাই এইভাবে সেনা সংগঠনের পদক্ষেপকে আধুনিক জাপান গঠনের পথে এক বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ আখ্যা দেন। তাঁর ভাষায়, “Universal conscription was probably the most revolutionary step in the modernization of Japan.”। কারণ প্রায় তিন শতাব্দী ধরে জাপানের সাধারণ জনগণ অস্ত্রধারণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। জাপানী সমাজের সামগ্রিক শ্রেণী বিন্যাস এই বিভেদ ও বিভাজনের (সাধারণ শ্রেণী ও সামুরাইদের মধ্যে) উপর নির্ভরশীল ছিল। সর্বজনীন বাধ্যতামূলক সেনা সংগঠনের এই আইনের মাধ্যমেই জাপানের অস্ত্রহীন কৃষক সমাজ হঠাৎ-ই জাপানের মত সংগঠিত কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়।
স্বাভাবিকভাবে সর্বজনীন সেনাসংগঠনের এই নীতি সম্পূর্ণ কার্যকর করতে বেশ কয়েক বছর লেগে যায়। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে এইভাবেই মেজী সরকার দেশের সর্বত্র সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।