StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

মেইজি জাপানে আধুনিকতার বিকাশের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য শিক্ষার গুরুত্ব

 

মেইজি জাপানে আধুনিকতার বিকাশের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য শিক্ষার গুরুত্ব 

মেজী সম্রটের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যেমন শোগুনতন্ত্র তথা সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটে তেমনি ভাবধারা ও শিক্ষাপদ্ধতি গ্রহণ করে জাপানকে আধুনিকতার পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। নতুন সরকারের নবীন নেতৃবৃন্দ বুঝতে পারেন যে পাশ্চাত্য শক্তির সমকক্ষ হতে হলে সেকেলে সমান্ততান্ত্রিক মানসিকতা পরিত্যাগ করে আধুনিক পাশ্চাত্য ভাষা ও শিক্ষাপদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।

১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রজাবর্গের উদ্দেশ্যে তাই সম্রাট ঘোষণা করেন যে বর্তমান সমগ্র বিশ্ব যেখানে প্রগতি অর্জন করেছে, প্রতিটি জাতি যেখানে সবদিকে সম্প্রসারিত হচ্ছে সেখানে জাপান পুরনো ঐতিহ্য ও প্রথাকে পালন করে যাচ্ছে। তাই তিনি জাপানবাসীকে তাদের সুখ সমৃদ্ধির জন্য এবং জাতীয় প্রভাবের অসীম সম্প্রসারণ ও সুদৃঢ় ভিত্তি প্রদানের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হন। রেস্টোরেশনের পর নতুন মেজী সম্রাটের পরামর্শদাতারা তাঁর মুখ দিয়ে সনদ আকারে যে শপথ বাক্য (Charter Oath) উচ্চারণ করান তা হল : “সাম্রাজ্যের ভিত শক্তিশালী করতে পৃথিবীর সবপ্রান্ত থেকে জ্ঞান আহরণ করতে হবে” (Knowledge shall be sought throughout the world so as to strenghthen the foundations of imperial rule)। জাপানী নেতৃবৃন্দ বুঝেছিলেন যে সফল শিল্পায়ন, সামরিক আধুনিকীকরণ ও প্রযুক্তির বিকাশের জন্য সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তির আধুনিকীকরণ প্রয়োজন। সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে (যেমন অর্থবিদ্যা) ভবিষ্যতে জাপানের সকল শ্রেণীর জনগণের বিপুল সাড়া দেওয়াটা যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সরকারের তরফে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া আধুনিক পরিকল্পনা ততটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। 

পাশ্চাত্য সামরিক কৌশল আয়ত্ত করা কিংবা প্রযুক্তি প্রয়োগের মধ্য দিয়েও পাশ্চত্য জীবনধারার ছাপ জাপানীদের মধ্যে পড়েছিল। জাপানীরা বুঝেছিল পাশ্চাত্যের সমরাস্ত্রের যদি প্রয়োজন থাকে তাহলে পাশ্চাত্য পোশাক পরিধান করা কিংবা পাশ্চাত্য প্রথায় করমর্দনে কোনো অসুবিধা নেই, বরং সুবিধাই বেশি। মেজী যুগের জাপানীরা পাশ্চাত্য সভ্যতার বাহ্য দিকগুলির প্রতিও যথেষ্ট আকর্ষণ বোধ করে। ঊনবিংশ শতকের আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা ও নিয়মকানুন এতটাই পাশ্চাত্য প্রভাবিত যে জাপানীদের আন্তর্জাতিক সমাজে স্থান করে নিতে হলে সামাজিক দিক থেকে তাদের সেই রীতিনীতি বা প্রথা গ্রহণ করতে হবে। পাশ্চাত্য রীতিনীতি, প্রথা ও প্রতিষ্ঠানসমূহ জাপানীদের মধ্যে প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন সম্রাট স্বয়ং।

পাশ্চাত্য সংস্কৃতি বিরোধী সম্রাট কোমেই (Komei)-এর মৃত্যুর পর নবীন সম্রাট মুৎসোহিতো তাঁর পূর্বসূরিদের মত জনগণের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেননি। উদার জ্ঞানদীপ্ত এই সম্রাট ইউরোপীয় সম্রাটদের আদবকায়দা আয়ত্ত করেন। নৌ ও সামরিক প্যারেড ও মহড়া পরিদর্শন করেন। কুচকাওয়াজ, রণসজ্জা, কিংবা মহাড়ায় ইউরোপীয় পোশাকে তদারকি, এমনকি খনি পরিদর্শন এবং উপনিবেশ বিস্তার সবক্ষেত্রেই সম্রাটের উপস্থিতি পাশ্চাত্য সভ্যতারই প্রভাবের ফল ছিল। সম্রাট শিন্টো ধর্মীয় আচারকেও ততটা গুরুত্ব দিতেন না যতটা তিনি পাশ্চাত্য ভাবধারা ও রীতিনীতি অনুসরণের ক্ষেত্রে দিতেন। এই সময় চীনের মাণ্ডুবংশীয় শাসকেরা কেউ পাশ্চাত্য পোষাক পড়ত না। অন্যদিকে জাপানী সম্রাট স্বয়ং তাঁর পোষাক পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, চুলের ছাট সবক্ষেত্রেই পাশ্চাত্য শৈলী প্রর্বতন করে প্রজাবর্গকে তা অনুসরণে অনুপ্রাণিত করেন। রাজপ্রাসাদের ভোজনশালায় পাউরুটি এমনকি গোরুর মাংস আহার্য হিসেবে গ্রহণে আর বাধা রইল না।

প্রাক্ মেজী যুগের বৌদ্ধ শোগুন শাসনে যা ভাবাও যেত না। পাশ্চাত্য ধর্মীয় বিশ্বাস আপানে আমদানির আগ্রহ না থাকলেও মেজী নেতৃবৃন্দ পূর্ব এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী চান্দ্ৰ ক্যালেন্ডারের (Lunar. Calendar) পরিবর্তে গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার চালু করেন। এরফলে সাতদিনে সপ্তাহ ও রবিবার ছুটির দিন ঘোষিত হয়। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব পর্যন্ত খ্রিস্টধর্ম বিরোধী আইনগুলিকে মাঝে মাঝে প্রয়োগ করা হত এবং মেজী শাসনের দ্বাদশবর্ষের পূর্বে বাইবেলের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ সম্ভব হয়নি। মেজী শাসনের দ্বাদশ বর্ষেই জাপানে বাসবাসকারী খ্রিস্টানদেরদের মোট সংখ্যা ছিল আনুমানিক ২৫ হাজার এবং এর তিন-চতুর্থাংশ হল রোমান ক্যাথলিক। এই সময় জাপানের মোট জনসংখ্যা ছিল ৩৪ মিলিয়ন। ধর্মভাবাপন্ন বিদেশী প্রযুক্তিবিদরাই জাপানে মিশনারিদের প্রভাবকে কার্যকর করেছিল।

বিদেশী প্রভাবে জাপানের নারী সমাজের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। শিন্টো ধর্ম বিশ্বাসে নারীদের অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভাল থাকলেও কনফুশীয় ও বৌদ্ধ চিন্তাধারায় তাদের হীন ভাবা হত। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দেই নারীরা প্রথম ধর্মীয় স্থানে বা মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি পায়। মিশন বোর্ডগুলি নারীদের জন্য ৪৩টি মহিলা স্কুল খোলে এবং পরে বিখ্যাত Tsuda কলেজ খোলে। এইভাবে নতুন সরকারের অসামরিক কর্তৃপক্ষ মেয়েদের শিক্ষার ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সুযোগের সম্প্রসারণ করে, যার ফলে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক চতুর্থাংশ শুধু মেয়েদের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। পোশাক-পরিচ্ছদে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে কম পরিবর্তন এসেছিল, কারণ তারা অন্তঃপুরেই বেশি সময় কাটাত। যাইহোক, ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাজ্ঞী নিজেই বিবাহিত মহিলাদের দাঁত কালো করার এবং ভ্রু কামানোর প্রাচীন প্রথা পরিত্যাগের নিদর্শন খাড়া করেন। তিনি এবং অন্যান্য রাজ পরিষদের অভিজাত মহিলারা ভিক্টোরীয় শৈলীর পোশাক পরিধান করতে শুরু করেন যা কিছুটা পরিবর্তিত আকারে এখনও অনুসৃত হয়ে আসছে।

পাশ্চাত্য প্রভাবে জাপানীদের জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তন আসে। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে সরকারি ডাক পরিষেবার সূচনা হয়। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ইয়োকোহামা (Yokohama) র রাস্তায় গ্যাসের আলো জ্বলে এবং ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে টোকিওতে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে। ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে জাপান আন্তর্জাতিক মেট্রিক চুক্তির সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তা সর্বসাধারণের জন্য ব্যবহৃত হয়। পাশ্চাত্যের চাকা (Wheel) ও প্রাচ্যের পেশী শক্তির অপূর্ব সমন্বয়ে জাপানে রিক্সা চালু হয় ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে। ঊনবিংশ শতকের এশিয়ার পরিবেশে রিক্সা খুবই প্রয়োজনীয় বাহনে পরিণত হয় যা জাপান থেকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বিংশ শতকের প্রথম দিকে জাপানে মোটরগাড়ির প্রচলন শুরু হলে রিক্সা ক্রমশ সেকেলে বাহনে পরিণত হয়।

১৮৭২ খ্রিঃ পাশ্চাত্য জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাসের অন্যতম অঙ্গরূপে জাপানী সম্রাট গোরুর মাংস খাওয়া শুরু করেন যা বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী অনৈতিক কাজ ছিল। “সুকিয়াকি” (Sukiyaki) নামক গোমাংসে প্রস্তুত ভোজনের এক পদ পাশ্চাত্য ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত একদল জাপানী যুবকের কাছে জাপানী সংস্কৃতির প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। এছাড়া পাশ্চাত্য ধাঁচের চুলের ছাট পাশ্চাত্যায়নের প্রতীকে পরিণত হয়েছিল, কেননা এর আগে জাপানীরা মাথার উপরের অংশ কামিয়ে তাদের দীর্ঘ চুল খোপা বানিয়ে রাখত। সামরিক বাহিনীতে, বিশেষ করে, পাশ্চাত্য চুলের ছাঁট বিশেষ প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ মাথার উপরে খোপা থাকলে পাশ্চাত্য সামরিক টুপি পড়তে অসুবিধা হত। রেস্টোরেশনের পর সরকারি নেতৃবৃন্দ ও শহুরে নাগরিকেরা পাশ্চাত্য ফ্যাশানে রপ্ত হয়ে ওঠে। সেই সময়কার ভারি দাড়ি রাখার পাশ্চাত্য প্রবণতাকেও জাপানে মুখ্য ব্যক্তিত্বরা অনুকরণ করতে থাকে। মেজী সম্রাট, ইটো হিরোবুমি ও অন্যান্য নেতাদের ছবি দেখলে বোঝা যায় যে তাঁরা দাড়ি ও গোফে সজ্জিত থাকতে ভালবাসতো। জাপানের সামরিক বাহিনী ও অসামরিক সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে পাশ্চাত্য পোশাক প্রবর্তিত হয়। অন্যদিকে সরকারি নেতৃবৃন্দ ও অন্যান্য প্রগতিবাদী জাপানীরা পাশ্চাত্য অসামরিক পোশাক গ্রহণ করে তা সাধারণ নাগরিকের জন্য নির্দিষ্ট করে দেন।

১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে রাজদরবারের এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে পাশ্চাত্য পোষাক পরিধানের নির্দেশ দেওয়া হয়। ইউরোপের সব সম্রাট ও রাষ্ট্র প্রধানদের মত জাপানী সম্রাট সর্বদা সামরিক পোষাকে জনসমক্ষে অবির্ভূত হতেন। মেজী যুগের পরবর্তী পর্বে পাশ্চাত্য “মর্নিং কোট” (Morning coat) এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে তা এখনো ব্যবহৃত হয় এবং বিংশ শতকের প্রথম পর্বে উঁচু কলার (high collar) বিশিষ্ট জামা ফ্যাশান সচেতন জাপানীদের অপরিহার্য অঙ্গে পরিণত হয়। জাপান ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে ইংরেজদের স্টাইলকে গ্রহণ করে।

পাশ্চাত্যায়নের এই হিড়িক ১৮৮০-এর দশকে উচ্চমাত্রা লাভ করেছিল। এই সময় জাপানীদের সামাজিক দিক থেকে ইউরোপীয়দের সমপর্যায়ভুক্ত করার জন্য ককেশীয়দের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের সরকারি নীতি গ্রহণের বিষয়টিও আলোচিত হয়। পাশ্চাত্য রীতিনীতিতে সমপর্যায়ভুক্ত পুরুষ ও নারীর মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়াসও নেওয়া হয়। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েদের বিদেশী ভাষা শিক্ষায় ও বলরুম নৃত্যে পারদর্শী করে তোলা হয়। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে বহু অর্থ ব্যয় করে রোকুমেইকান (Rokumcikan) নামক এক বিশাল সামাজিক মিলন গৃহ (Social hall) গড়ে তোলা হয় যেখানে সম্ভ্রান্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও কূটনীতিবিদদের জন্য নাচের আসর বসত।

১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে উচ্চ সরকারি পদাধিকারীদের উপস্থিতিতে এক শৌখিন পোশাকের নৃত্য আয়োজিত হয়। জাপানের রক্ষণশীল মহলে পাশ্চাত্যের এই অন্ধ অনুকরণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। বাস্তবে সবক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের এই অন্ধ অনুকরণের ফল ভাল হয়নি। জাপানের শহরগুলিতে পাশ্চাত্যের শিল্প-স্থাপত্য, বিশেষ করে ভিক্টোরীয় শৈলীর অন্ধ অনুকরণের ফলে নতুন অট্টলিকাগুলি বিশ্রিরূপ ধারণ করে। পাশ্চাত্য ঘরগুলির পশ্চিমী অলঙ্করণ ও অঙ্গশয্যা ছিল আরো কুৎসিত। এদিকে পৃষ্ঠপোষণার অভাবে দেশীয় শিল্প-স্থাপত্য তখন ধুঁকতে শুরু করে, এমনকি কাঠের ব্লক প্রিন্টিং-এর মত বিখ্যাত শিল্প তখন অনাদরে হারিয়ে যেতে বসেছিল। এই সময় অন্ধ পাশ্চাত্যায়নের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হলে পাশ্চাত্যায়নের প্রক্রিয়া মন্থর হয়।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *