চীনের কম্প্রাদর শ্রেণী সম্পর্কে একটি টীকা লেখ ।
আধুনিক চিনের ইতিহাসে একটি নতুন সামাজিক শ্রেণী হল কম্প্রাদর। এরাই চিনের পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠাতা। যেসব চিনা বণিক বন্দরগুলিতে বিদেশিদের সঙ্গে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করেছিল তারা হং বণিক। এই হং বণিকদের মধ্যে থেকে পরবর্তীকালে কম্প্রাদর শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এই কম্প্রাদর শ্রেণী অবশ্যই ছিল বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত সহযোগী গোষ্ঠী। বিদেশিরা যারা চিনে বাণিজ্য করতে আসত তারা চিনা ভাষা জানত না, আবার চিনারা ইংরাজি বা ইউরোপীয় ভাষা জানত না। এদের মধ্যে দোভাষীর কাজ করত কম্প্রাদর শ্রেণী (The principal link between the foreign merchant who spoke no Chinese and his customer or supplier from Chungking or Hankow who spoke no English was the comprador)।
কম্প্রাদর বিদেশি সংস্থায় কাজ করত, হিসেব রাখা ও মুৎসুদ্দির নানা কাজ এদের করতে হত। কোম্পানির কাজ করেও এরা নিজেদের ব্যবসা গড়ে তুলত, অনেকে সম্পদশালী হয়েছিল। অনেকসময় কম্প্রাদর বিদেশি কোম্পানিগুলিকে চিনের পণ্য সরবরাহের দায়িত্ব নিত, আবার বিদেশিরা যে পণ্য চিনে আমদানি করত তা বাজারজাত করার দায়িত্ব ছিল তাদের। চিনের বৈদেশিক বাণিজ্যের আমদানি ও রপ্তানি এরা নিয়ন্ত্রণ করত। কম্প্রাদর চিনা বণিকদের আমদানি পণ্য কেনার জন্য মূলধন সরবরাহ করত।
এই কম্প্রাদর শ্রেণী হল আধুনিক চিনের পুঁজিপতি শ্রেণী। এরা ধনী হয়ে বা ব্যাংকের ঋণ নিয়ে নানা ধরনের শিল্প স্থাপন করেছিল। জাহাজ নির্মাণ, বস্ত্রকল স্থাপন, কয়লা খনিতে পণ্য উত্তোলন, রেশম, চা, আফিম, ময়দা, তেল, কাগজ, দেশলাই শিল্প কম্প্রাদরদের উদ্যোগে স্থাপিত হয়। এদের অনেকে পরিবহন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল (Many of the original investors in Chinese owned shipping, financial and ‘manufacturing enterprises were men who had grown wealthy as compradors of the leading foreign firms in Sanghai)।
বিভিন্ন শিল্প, বাষ্পীয় পরিবহন, ডাক-তার ও রেলপথে এরা মূলধন লগ্নি করেছিল। চিনে চিনা ও জাপানিরা আমদানি-রপ্তানি সংস্থা স্থাপন করলে বৈদেশিক বাণিজ্যের মধ্যস্থ হিসেবে কম্প্রাদরদের গুরুত্ব কমেছিল (The increase in the number of Chinese and Japanese owned export-import houses after 1911 reduced the overall significance of the compradors as the link between foreign trade and Chinese marketing system)। তবে কম্প্রাদর শ্রেণীর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়নি। বিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত কম্প্রাদর শ্রেণী চিনে পুঁজিবাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। টিকে ছিল। ব্যাংকিং, বৈদেশিক বাণিজ্য, শিল্প, পরিবহন, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য ও মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে এই সদ্যোজাত পুঁজিপতি শ্রেণী তাদের ভূমিকা অক্ষুণ্ণ রেখেছিল।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার একটি বিধ্বস্ত অর্থনীতির উত্তরাধিকার লাভ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেকার সঙ্গে তুলনায় শিল্প উৎপাদন কমেছিল ৫৬ শতাংশ, খাদ্য ৭০ শতাংশ, মুদ্রাস্ফীতি ছিল নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বন্যার কবলে পড়ে ৩০-৪০ শতাংশ জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নতুন সরকার জরুরি ভিত্তিতে দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজ হাতে নিয়েছিল। শিল্প ও কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তন করেছিল জনগণের মুদ্রা (জেন মিন পিয়াও), বিদেশি সব মুদ্রার প্রচলন বাতিল করা হয়েছিল। সরকার দেশের দ্রব্যমূল্য ও মজুরি স্থিতিশীল করার উদ্যোগ নিয়েছিল (Price and wage stabilization)। কাগজি মুদ্রা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে মজুরিস্তর স্থিতিশীল করার প্রয়াস চালানো হয়। পাঁচটি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাল, তেল, কয়লা, ময়দা ও বস্ত্রের দাম স্থিতিশীল রেখে মজুরের প্রকৃত মজুরি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে নজর দেওয়া হয় (The average salary of workers varied in money value but not in actual purchasing powers)।
মধ্যবিত্তের সঞ্চয় যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে লক্ষ রেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মুক্তি ফৌজ অতি দ্রুত দেশের যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে পণ্যের চলাচল অবাধ করেছিল। সরকার কর ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস করে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, বিক্রি ও ওপর কর স্থাপন করেছিল। এসব ব্যবস্থা নিয়ে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বাজেটে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। সরকার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করলে কম্প্রাদর শ্রেণীর ভূমিকা অবশ্যই সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। সরকার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্প স্থাপন করলে কম্প্রাদররা সেখানে মূলধন বিনিয়োগ করেছিল। ছোটোখাটো শিল্প-বাণিজ্যে কম্প্রাদরদের ভূমিকা সরকার মেনে নিয়েছিল, এতে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিকল্পিত হার বজায় রাখা সম্ভব হয়। নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কম্প্রাদর শ্রেণীর গুরুত্ব কমেছিল কিন্তু এদের ভূমিকা একেবারে লোপ পায়নি। ছোটখাট শিল্প ও বাণিজ্যে এদের ভূমিকা অটুট ছিল।