StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

ক্যান্টন বাণিজ্যের গুরুত্ব আলোচনা কর

 

ক্যান্টন বাণিজ্যের গুরুত্ব আলোচনা কর । 

১৭৫৯-১৮৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্যান্টন বন্দরের মাধ্যমে চিনের বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালিত হত। এই বাণিজ্য ছিল এক বন্দর কেন্দ্রিক (single port trade), চিনের অন্য কোনো বন্দরে বিদেশিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ইংরেজ বণিক জেমস ক্লিট উত্তরের নিংপো, অ্যাময় ও সাংহাইয়ের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রয়াস চালিয়ে ব্যর্থ হন। ক্যান্টন বন্দর-শহরের বাইরে পার্ল নদীর ধারে তেরোটি বিদেশি বাণিজ্য সংস্থা তাদের বাণিজ্য কুঠিগুলি গড়ে তুলেছিল, প্রায় একুশ একর জমির ওপর। এজন্য হং বণিকদের জমির খাজনা দিতে হত। ব্রিটিশ, মার্কিন, ফরাসি, ওলন্দাজ, বেলজিয়ান, সুইডিস, দিনেমার ও স্পেনীয়দের কুঠি এখানে ছিল। চিনাদের কাছে এগুলি ছিল বর্বরদের আবাসগৃহ। ক্যান্টন বাণিজ্যের ধরন হল একচেটিয়া (The essence of this system was monopoly coupled with responsibility, with little room left for free private enterprise)।

চিনের রাজদরবার তেরোটি চিনা বাণিজ্য সংস্থাকে (হং) ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্য করার একচেটিয়া অধিকার দিয়েছিল। এরা একটি সংস্থা গঠন করে কোহং নামে পরিচিত হয়, এদের সদস্যদের হয় বণিক বলা হত। রাজদরবারে এককালীন অর্থ দিয়ে এরা বাণিজ্যের অধিকার লাভ করত। এদের কাজের তদারকি করতেন ক্যান্টন বন্দরের চিনা শুল্ক অধ্যক্ষ হলো, এই হপ্পোেরা হং বণিকদের কাছ থেকে উৎকোচ ও উপহার আদায় করতেন। এদের ওপরে ছিলেন স্থানীয় গভর্নর জেনারেল।

চিনের দক্ষিণের এই বন্দরটি ছিল বহু পুরোনো, ভৌগোলিক দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পর্তুগিজরা ষোড়শ শতকের গোড়ার দিকে এই বন্দরের সঙ্গে বাণিজ্য করত। এখানে যেসব চিনা বণিক বৈদেশিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল তাদের তিনটি ভাগ ছিল—একদল পশ্চিমি বণিকদের সঙ্গে বাণিজ্য পরিচালনা করত, অন্য দল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্য চালাত আর তৃতীয় দল উত্তরের ফুকিয়েন ও চাওচায়ের সঙ্গে বাণিজ্যরত ছিল।

জ্যঁ শ্যেনো জানিয়েছেন যে ক্যান্টন বন্দরের বাণিজ্যকে ঘিরে চিনা বণিকদের মধ্যে একটি প্রভাবশালী বাণিজ্যিক অভিজাততন্ত্রের আবির্ভাব হয়। চিনা বণিকদের সংস্থা কোহং বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ও পণ্য মূল্য নির্ধারণ করত, বিদেশিদের কাছ থেকে অগ্রিম নিত। পিডগিন নামক ইংরেজি ও চিনার এক মিশ্র ভাষায় এরা পরস্পরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালাত। এই বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল কম্প্রাদর (হিসেব রক্ষক, দালাল ও কোষাধ্যক্ষ), দোভাষী, স্রফ বা মহাজন এবং করণিক।

বিদেশিদের সকলে সরাসরি বাণিজ্য করত না, যেমন ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজে বাণিজ্য করত, অন্যদের বাণিজ্য করার অনুমতি দিত (country trade), কোম্পানির জাহাজের ক্যাপ্টেন ও নাবিকরা কিছু ব্যক্তিগত ব্যবসা করতে পারত এবং কোম্পানির যেসব কর্মচারী ক্যান্টনে থাকত তারাও ব্যক্তিগত বাণিজ্যের সুযোগ পেত, ( company country traders, crews and supercargoes)। এই বাণিজ্যের একটি বড়ো অংশ কোম্পানির বাইরে স্বাধীন বণিকদের হাতে ছিল।

চিনের নজরানা প্রথা থেকে উদ্ভুত নিয়ন্ত্রিত এক বাণিজ্যের রূপ হল ক্যান্টন বাণিজ্য। চিন নিজেকে সব দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক দেশ বলে গণ্য করত, বিদেশি কোনো পণ্যের প্রতি চিনের আকর্ষণ ছিল না, এমনকি নতুন প্রযুক্তিগত উৎপাদনও চিনাদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। চিনা দরবার ক্যান্টন বাণিজ্যকে কখনও বিদেশিদের অধিকার হিসেবে গণ্য করেনি, মধ্য রাজ্যের দান হিসেবে গণ্য করেছে। বিদেশিরা যদি চিনের নিয়ম-রীতি মেনে বাণিজ্য করে সম্রাটের আপত্তি নেই, নিয়ম-রীতি ভঙ্গ করা হলে তা বাতিল করা হবে।

ক্যান্টনে চিনা বণিকদের দিতে হত পণ্য পরিমাপ ও ওজন বাবদ পারিশ্রমিক (measurement fee), উপহার ও বাণিজ্য শুল্ক। এসব উপহারের একাংশ সম্রাট ও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা পেতেন। ক্যান্টন বন্দরে কর্মরত বিদেশিদের কয়েকটি আরোপিত মেনে চলতে হত। বিদেশিরা তাদের কুঠির বাইরে যেতে পারত না, সরাসরি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করার অধিকার তাদের দেওয়া হয়নি। বাণিজ্য কাজ শেষ হলে তাদের বন্দর ছেড়ে চলে যেতে হত (foreigners must not remain in Canton after the trading season)। বিদেশি কুঠিগুলিতে মহিলাদের নিযুক্ত করার অস্ত্রশস্ত্র রাখার অধিকার ছিল না। বিদেশিদের চোখে সবচেয়ে আপত্তিকর শর্ত হয়। কোনো বিদেশি অপরাধ করলে চিনের আইন অনুযায়ী বিচার হত ( All foreigner remained subject to the procedures of Chinese criminal law) বিদেশি নৌকা করে বন্দরের নদীতে স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করতে পারত না। এত বিধি-নিষেধ সত্ত্বেও হং বণিকদের সঙ্গে বিদেশিদের সম্পর্ক খারাপ ছিল না।

মার্কিন বণিক উইলিয়াম হান্টার হং বণিকদের উচ্চ প্রশংসা করেছেন। তিনি লিখেছেন যে এরা ছিল সম্মানিত ব্যক্তি, বিশ্বস্ত, যথাযথভাবে চুক্তি মেনে চলার পক্ষপাতী এবং উদারহৃদয়। বিদেশি বণিকদের সঙ্গে এদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, আর্থিক কোনো অসুবিধা দেখা দিলে এরা পরস্পরকে সহায়তা দিত (The hong merchants were a body of men honourable and reliable in all their dealings, faithful to their contracts and large-minded They shared a spirit of comraderie with the foreign trader, each helping the other out in times of difficulty and insolvency)!

অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ক্যান্টন বন্দরকে ঘিরে, বিদেশিদের নানা অসুবিধা ও আপত্তি সত্ত্বেও, চিন, ভারত ও ইংল্যান্ডের মধ্যে এক সমৃদ্ধ বাণিজ্যের উত্তর ও সম্প্রসারণ ঘটে (By the late 18th century there was a flourishing triangular trade between Canton, India and England)। ক্যান্টন বাণিজ্যের বেশিরভাগ ছিল ইংল্যান্ডের সঙ্গে। চিন থেকে ইংরেজ বণিকরা কিনত চা, ইংল্যান্ড ও ইউরোপে চায়ের, বিশেষ করে কালো চায়ের, বিপুল চাহিদা তৈরি হয়েছিল। চিনের রপ্তানিযোগ্য অন্য উৎপাদিত পণ্য হল কাঁচা রেশম, পোর্সেলেনের বাসনপত্র, নানকিং-এ উৎপাদিত সুতিবস্ত্র ও অন্যান্য কিছু কুটির শিল্পজাত পণ্য। কেমব্রিজ হিস্ট্রিতে চিন-ভারত বাণিজ্য বৃদ্ধির অন্য একটি কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চিন বাণিজ্যের মধ্য দিয়ে কোম্পানি অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে তার বিনিময় সমস্যা মিটিয়েছিল (The East India Company continued in business at Canton because the company ruled India, and China was the best medium of remittance for surplus Indian revenue needed to service the £28 million in debts engaged in London to pay the cost conquering India in the first place)।

ক্যান্টন বাণিজ্য যে বেড়ে চলেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দে এই বন্দরে এসেছিল মোট উনিশটি বিদেশি জাহাজ, ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে এর সংখ্যা বেড়ে হল ৫৭। বিদেশিরা চিনে নিয়ে আসত পশমি কাপড়, দস্তা, টিন, লোহা, তামা, পশম, লিনেন এবং ইউরোপে সদ্য প্রস্তুত নানা যন্ত্রপাতি। ইংরেজ বণিকরা (এদের মধ্যে কয়েকজন ভারতীয় ও পারসি বণিকের নাম আছে) এখানে আমদানি করত ভারতের সুতো, হাতির দাঁত, চন্দন কাঠ, রুপো ও আফিম। আফিম আমদানির পরিমাণ বাড়তে থাকে আর তা নিয়ে চিনাদের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়।

ইংরেজরা ভারতে রপ্তানি করত চিনের নানকিং শহরে প্রস্তুত বস্তু, ফিটকিরি, কর্পূর, মরিচ, চিনি, ওষুধ ও চিনের বাসনপত্র। বিদেশিরা এই নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য মেনে নিয়েছিল কারণ এই বাণিজ্যে খুব বেশি লাভ হত। সাধারণত হং বণিকদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হত না, বিদেশিদের সঙ্গে বাণিজ্য সংক্রান্ত কোনো বিরোধ দেখা দিলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তা মেটানো হত। কিন্তু বিদেশিরা কোনো অপরাধ করলে বা নরহত্যার ঘটনা ঘটলে চিনের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হত। ক্যান্টন বাণিজ্যে লাভের পাল্লা ছিল চিনের দিকে কারণ চিন বিদেশিদের আমদানি করা খুব কম পণ্যই কিনত। ১৭৭৫ 

১৭৯৫ সময়কালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ৩১.৫ মিলিয়ন টায়েলের পণ্য আমদানি করেছিল, রপ্তানি করেছিল ৪৬.৬ মিলিয়ন টায়েল মূল্যের পণ্য। বেসরকারি স্তরে যে বাণিজ্য চলত তাতে লাভের পাল্লা ছিল বিদেশিদের দিকে, এই খাতের উদ্বৃত্ত দিয়ে কোম্পানির ঘাটতি মেটানো হত।

হং বণিকদের মূলধন জোগাড় হত বাণিজ্য লাভ থেকে, লাভের পরিমাণ নেহাত কম হত না (The cohong’s capital came from profits earned by selling tea and textile to monopoly trading organizations like the British East India Company)। এই বাণিজ্যে দুর্নীতি ও উৎপীড়ন ছিল, ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে হং বণিকরা কনসু তহবিল (Konsoo Fund) গঠন করেছিল। গোড়ার দিকে সদস্যরা তাদের আয়ের দশ শতাংশ এই তহবিলে জমা করত। উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও দরবারের দাবি মেটানোর জন্য এটি গঠন করা হয়েছিল, বিষয়টি গোপন করে রাখা হয়। পরে এটি দরবারের স্বীকৃতি পেয়েছিল।

বৈদেশিক আমদানি পণ্যের ওপর ৩ শতাংশ শুল্ক বসিয়ে অর্থসংগ্রহ করা হয়। কোনো হং বণিক দেউলিয়া হয়ে পড়লে এই তহবিল থেকে বিদেশিদের প্রাপ্য অর্থ মেটানো হস্ত। এই বাণিজ্যের অন্যদিক হল চিন-ভারত বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটেছিল অথচ চিন বিদেশিদের আমদানি করা পণ্য তেমন কিনত না। চিনের সঙ্গে বাণিজ্য পরিচালনার জন্য কলকাতায় পনেরোটি এজেন্সি হাউস গড়ে উঠেছিল। এরা  ব্যাংকিং, বিমা, পরিবহন ও বাণিজ্য এজেন্ট হিসেবে কাজ করত। (The English could find nothing manufactured in Europe which the Chinese would consume in quantities proportional to the gigantic Englsih demand for tea)1

অষ্টাদশ শতকের শেষে ও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ক্যান্টনের নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশ জাতি প্রাচ্যের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালিয়েছিল। ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথা একটি বিশেষ সময়ের সঙ্গে হয়তো সংগতিপূর্ণ ছিল কিন্তু শিল্প বিপ্লবোত্তর ইংল্যান্ডের ধ্যান ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না (It would have been hard to devise a more effective institution to fit under the wing of the ancient Chinese tributary system)। ব্রিটিশ সরকার উদ্যোগী হয়ে ক্যান্টন ব্যবস্থার বিধিনিষেধ দূর করে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী চিনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক গঠনের প্রয়াস চালিয়েছিল। বিদেশিদের প্রধান অভিযোগ ছিল তিনটি—এক বন্দর বাণিজ্য, ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর আরোপিত বিধি-নিষেধ এবং জবরদস্তি অর্থ আদায়। চিন সরকার বিদেশিদের দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে বাণিজ্য করার অনুমতি দেয়নি। ব্রিটিশ সরকার চিন সরকারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার জন্য তিনবার দ্রুত পাঠিয়েছিল।

১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে কর্নেল ক্যাথকার্টকে পিকিং-এ পাঠানো হয়, পথে তিনি মারা যান। ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ম্যাকার্টনি প্রাচ্যে ব্রিটিশ বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য চিনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে গিয়েছিলেন (The mission was entrusted with the task of opening the whole East to British trade and of placing relations with China on a regular treaty basis)! ম্যাকার্টনি মিশনও সফল হয়নি, তার বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব চিন সম্রাট চিয়েন লুং বাতিল করে দেন (We possess all things. We have no use for your country’s manufactures)। ইতিমধ্যে চিনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের আরও কয়েকটি বিষয় নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়েছিল। কোম্পানি নেপালের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল (১৮১৪-১৬), নেপাল ছিল চিনের করদ রাজ্য। চিনের উপকূলে মার্কিন স্টিমার হান্টার ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ দখল করে নিয়েছিল। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে লর্ড আমহার্স্ট সরকারের দূত হিসেবে চিনে যান, তিনিও সফল হতে পারেননি।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *