ক্যান্টন বাণিজ্য পতনের কারণ গুলি আলোচনা করো। ক্যান্টন বাণিজ্য অবসানের কারণ গুলি আলোচনা কর।
বিদেশী বণিকদের ব্যক্তিগত জীবনের উপর নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা ও ক্যান্টন বাণিজ্যের সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য পাশ্চাত্য রাষ্ট্রবর্গ সমমর্যাদার ভিত্তিতে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বাণিজ্যিক শর্ত শিথিল করার বিষয়ে চীনারা বিশেষ আগ্রহী ছিল না। বিদেশী বণিকদের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের জন্য তারা সর্বদাই ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিত। তাদের ব্যাখ্যায় বাণিজ্য ছিল বিশেষ সুবিধা (Privilege), অধিকারের বিষয়বস্তু নয়, যা বন্ধ করে দেওয়ার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা চীনা কর্তৃপক্ষের আছে। বিদেশীদের বিরুদ্ধে ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিকে চীনারা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করত। চীনা কর্তৃপক্ষের আরোপিত সব শর্তই তাই বিদেশীদের মেনে চলতে হত।
ক্যান্টন ছাড়া বিদেশিরা অন্য বন্দরে ঢুকতে পারত না। হং বণিকদের মাধ্যমে বিদেশিদের বাণিজ্য করতে হত। ক্যান্টনে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে তাদের প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে বাস করতে হত। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে চিন সম্রাট মাত্র নয় জন চিনা বণিককে বিদেশিদের সঙ্গে বাণিজ্য করার অধিকার দেন। এরা কো-হং নামে পরিচিত ছিল (In 1760 the government formally recognised as a Co-Hong a Corporation of nine merchants who monopolised the foreign trade)। সরকার বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে যে শুল্ক পেত তা ছিল অতি সামান্য।
ক্যান্টন বাণিজ্য পতনের কারণ ছিল কো-হং বণিকদের দুর্নীতি। কো-হং বণিকরা বিদেশিদের কাছ থেকে বেশি হারে শুল্ক আদায় করত কিন্তু সরকার তার অংশীদার হত না। বিদেশি বণিকরা এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বারবার আবেদন জানাত কিন্তু কোনো ফল হত না। হং বণিকরা বিদেশিদের কাছ থেকে ঋণ নিত এবং এই ঋণ তারা প্রায়ই পরিশোধ করতে পারত না। সরকারি অর্থও তারা সময়মতো পরিশোধ করতে পারত না, এজন্য সরকার একবার কো-হং ব্যবস্থা তুলে দিয়েছিল, পরে আবার এই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়। বিদেশিরা তাদের ব্যবসা সংক্রান্ত অভাব-অভিযোগ সরাসরি সরকারকে জানাতে পারত না, হং বণিকদের মাধ্যমে সরকারকে সব জানাতে হত।
এক বন্দর কেন্দ্রিক এই একচেটিয়া বাণিজ্য পশ্চিমি দেশগুলি পছন্দ করেনি, তারা চিনের সঙ্গে অবাধ মুক্ত বাণিজ্য চেয়েছিল। ইউরোপে অবাধ বাণিজ্যের পক্ষে জনমত তৈরি হয়েছিল। উল্লেখ্য, চিনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের বাণিজ্য বেড়ে চলেছিল। শুধু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারি বাণিজ্য নয়, কান্ট্রি ট্রেড ও প্রাইভেট ট্রেড বেড়ে চলেছিল। বেসরকারি ইংরেজ বণিকদের বাণিজ্য সরকারি বাণিজ্যের চেয়ে বেশি হয়ে যায়।
ভারতের অইংরেজ বণিক, জাহাজের ক্যাপ্টেন “ও নাবিকরা এই বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। পশ্চিমি বণিকরা হংকং ও লিগটিন থেকে চিনের বেসরকারি বণিকদের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করেছিল। আফিম ছিল প্রধান পণ্য, লাভের পরিমাণ দাঁড়াত খুব বেশি। চিনে বাণিজ্য করার জন্য বেসরকারি বণিকরা ভয়ংকর আগ্রহী হয়ে উঠেছিল।
১৮৩৪ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য বন্ধ হলে হং বণিকদের মাধ্যমে বাণিজ্য পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্রিটিশ বণিকদের ক্যান্টন বন্দরের নানা বিধি-নিষেধের মধ্যে বাস করতে হত। কুঠির বাইরে যাবার অনুমতি ছিল না, অস্ত্রশস্ত্র বহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। ইংরেজদের কুঠিতে মহিলাদের নিয়োগ নিষিদ্ধ ছিল। ক্যান্টনে বাণিজ্য ঋতু শেষ হলে বিদেশিদের শহর ছেড়ে চলে যেতে হত। রোগের মধ্যে (হুমেন) বিদেশি জাহাজের ঢোকার অনুমতি ছিল না। চিনা পাইলট ও কম্প্রাদরদের সরকারি অনুমতিপত্র নিয়ে বিদেশিদের কাজ করতে হত, স্বাধীনভাবে তারা বিদেশিদের কাজ করতে পারত না।
ক্যান্টন বাণিজ্য নিয়ে শিল্প-বিপ্লবোত্তর ইংল্যান্ডের সঙ্গে চিনের বিরোধ বেধেছিল। ইংল্যান্ড আধুনিক যুগোপযোগী বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে বাণিজ্য করতে চেয়েছিল। ভারতের এজেন্সি হাউসগুলি চিন বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ব্রিটিশ সরকার তার বাণিজ্য স্বার্থ রক্ষার জন্য শক্তি প্রয়োগের কথা ভেবেছিল। চিন সরকার ইংল্যান্ডের শক্তি সামর্থ্য সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত ছিল না, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতির খবর তারা রাখত না। বিদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের তাৎপর্য চিনের শাসকগোষ্ঠী উপলব্ধি করতে পারেনি। চিনের রাষ্ট্র নেতারা চিনকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ বলে গণ্য করত, বিদেশি পণ্যের প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে। করত না। বিদেশিদের বাণিজ্য করার অনুমতি দিয়ে তারা আনুকূল্য দেখিয়েছিল। এদের দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক পার্থক্য তৈরি হয়েছিল। সমতার ভিত্তিতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তারা মানতে চায়নি। এর পরিণতি হল আফিম যুদ্ধ এবং ক্যান্টন ব্যবস্থার পতন, যুদ্ধের পর চুক্তিভিত্তিক সন্ধি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।
ক্যান্টন বাণিজ্য পতনের অন্যতম কারণ ছিল “Country trade” এবং Private trade ব্যবস্থা।ইতিমধ্যে ক্যান্টন বাণিজ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। “Country trade” এবং Private trade-এর দ্রুত বিকাশ বিশেষ করে ভারত থেকে চোরাপথে আফিম চীনে আসতে শুরু করলে ক্যান্টন বাণিজ্যের চরিত্র বদলায়। ক্যান্টনে Private trade ১৭৮০-৮১ খ্রিস্টাব্দে ছিল ৬৮৮,৮৮০ টেইল যা ১৭৯৯-১৮০০ খ্রিস্টাব্দে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৯৯২,৪৪৪ টেইল এবং একই সময়ে “Country trade” ১,০২০,০১২ টেইল থেকে বেড়ে গিয়ে ৩৭৪৩,১৫৮ টেইলে দাঁড়ায়। পরবর্তী শতকে এই ব্যবসার বিকাশের গতি আরও দ্রুত হয়। ১৮১৭-১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে চীনে ব্রিটিশ আমদানির তিন-চতুর্থাংশ ছিল এই “Country trade” এবং Private trade।
ব্যক্তিগত ইংরেজ বণিকদের অনেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হস্তক্ষেপ এড়াবার জন্য অন্য ইউরোপীয় দেশগুলির কনসালপদ গ্রহণ করে ক্যান্টনে থেকে যেত এবং তাদের বাণিজ্যের বিকাশ ঘটাত। তারা অনেক সময়ই লন্ডনের এবং ভারতের ফার্মগুলির এজেন্সী হাউসরূপে পরিষেবা দিত এবং আফিম চোরা চালানের লাভজনক অবৈধ ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিল। দ্রুত লাভের জন্য তারা ক্যান্টনের বাইরে লিনটিন এবং হংকং-এর মত স্থানে অ-হং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্যিক আদান প্রদান চালাত।
ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরা অর্থ ও প্রতিপত্তিতে এতটাই ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল যে তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার অবসানের জন্য সোচ্চার হয়। ১৮১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ক্যান্টন বাণিজ্যের রং বদলায় অর্থাৎ Private trade বা ব্যক্তিগত ব্যবসা কোম্পানীর বাণিজ্যকে ছাপিয়ে যায় এবং আমদানি পণ্য হিসেবে আফিম নিয়মিত আমদানি পণ্য সামগ্রীকেও অতিক্রম করে। এই দ্বিবিধ বিকাশই ক্যান্টন বাণিজ্য ব্যবস্থার পতন সূচিত করে। আফিমের ব্যবসা কেন্দ্র করে ইঙ্গ-চীন সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত হয়ে ওঠে যা শেষ পর্যন্ত আফিমের যুদ্ধের (১৮৩৯-৪২) রূপ নেয়। এই যুদ্ধে চীনের পরাজয়ের ফলে ক্যান্টন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। ক্যান্টন ছাড়াও অন্যান্য বন্দর উন্মুক্ত হয় এবং ক্যান্টন বাণিজ্য পদ্ধতির পরিবর্তে গড়ে ওঠে “Treaty System” বা সন্ধি পদ্ধতি।
উনিশ শতকের গোড়া থেকে চিনের সঙ্গে কোম্পানির বাণিজ্য দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছিল (The growth was more rapid after the turn of the (century)। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ক্যান্টন বাণিজ্যে বেসরকারি বণিকদের প্রাধান্য স্থাপিত হয়, তারা ইংরেজ কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার তুলে দিতে বলেছিল। আফিম আমদানি সব আমদানি পণ্যের ওপর স্থান করে নিয়েছিল। ক্যান্টন বাণিজ্যের এই দুই বৈশিষ্ট্য—একচেটিয়া নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্য ও ক্রমবর্ধমান আফিম আমদানি ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথার পতন ঘটিয়েছিল।