ক্যান্টন বাণিজ্য প্রথার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি কী ছিল।
1) ক্যান্টনে বিদেশী বণিকরা বাণিজ্য চলাকালীন সারা বছর ধরে থাকতে পারত না। গ্রীষ্মকালে অথবা বাণিজ্য মরশুম শেষে পরবর্তী বাণিজ্য মরশুম শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদের ম্যাকাও-এ কাটাতে হত। ক্যান্টনে বাণিজ্য চলকালীন বিদেশী বণিকেরা তাদের স্ত্রীপুত্রদের ম্যাকাও-এ রেখে আসতে বাধ্য হত। কো-হং-এর মাধ্যমে বিদেশী বাণিজ্যের পরিমাণ ও মূল্য নির্ধারিত হত। বাণিজ্যের যাবতীয় শর্তাদি চীনারাই ঠিক করত। বাণিজ্য শুল্কের হার পরিবর্তনশীল ছিল এবং এর অতি অল্প পরিমাণ অর্থ পিকিং-এ পৌঁছত। বাকী আয় হং বণিকরা গ্রাস করত।
2) ক্যান্টন বাণিজ্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল কোন হং বণিক সংগঠন। হং বণিকরা দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠেছিল। কারণ একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার পাওয়ার জন্য তাদেরও চীনা রাজদরবারে এবং শুল্ক অধিকর্তা Hoppo-কে অর্থ প্রদান করতে হত।
3) চীনা বণিকদের গিল্ড কো-হং ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে অবলুপ্ত হলেও ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে তা পুনরুদ্ধার করা হয় এবং ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। কো-হং (Co-Hong)-এর পুনরুজ্জীবনের ফলে এর চরিত্রগত তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি—বাণিজ্যিক একাধিপত্য অব্যাহত ছিল, শুধু চীনা ফার্মের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। (প্রত্যেক বিদেশী বণিককে হং বণিকের মাধ্যমে পণ্য ক্রয় বিক্রয় করতে হত। ক্রয়ের নূনতম দাম এবং বিক্রয়ের ঊর্দ্ধতম মূল্য তাদের দ্বারা স্থিরীকৃত হত।
4) কো-হং বিদেশী বণিক এবং চীনের সরকারী অধিকরণের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে কাজ করত। সমস্ত চিঠিপত্র, আবেদনপত্র এমনকি হং বণিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও তাদের মাধ্যমেই প্রদান করতে হত। অন্য চীনাদের সঙ্গে বাণিজ্য করতে হলে তা হং বণিকদের মাধ্যমেই করতে হত।
5) ক্যান্টনে পাশ্চাত্য বণিকদের নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হত। কোন বিদেশী জাহাজকে বোগ (Bogue)-এ ঢুকতে দেওয়া হত না। বাণিজ্য কুঠিতে বিদেশী মহিলা ও আগ্নেয়াস্ত্রের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। বিদেশী বণিকরা স্বাধীনভাবে নদীতে নৌকা চালাতে পারতেন না। বিদেশী ফ্যাক্টরী বা বাণিজ্যকুঠিতে কোন দাসী নিয়োগ করতে পারত না এবং চীনা ভৃত্যের সংখ্যা কখনো ৮ এর বেশী হতনা। বাণিজ্য মরশুম শেষে বিদেশী বণিকদের ক্যান্টন ত্যাগ করতে হত। এমনকি বাণিজ্য মরশুমে জাহাজ ভর্তির সময়ও তাদের ম্যাকাও (Macao) – এ ফিরে যেতে হত।
6) বিদেশী বাণিজ্য জাহাজগুলি হোয়ামপোয়া (Whampoa) ছাড়া আর কোথাও নোঙর করতে পাতেন না। বিদেশীরা কোন চীনা ভাষার গ্রন্থ ক্রয় করতে এবং চীনা ভাষা এ শিখতে পারতনা। বিদেশী বণিকদের কাছে হং বণিকরা কখনো ধার নিতে পারতনা। বিদেশী বণিকদের সঙ্গে চীনাদের বাণিজ্যিক আদান প্রদানের এই কঠোরতা চীনের রুদ্ধদ্বার নীতি (Closed Door Policy)-র অংশ ছিল। পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গীতে এই নীতিকে “রুদ্ধদ্বার নীতি” বলা হলেও চীনা আমলারা একে রুদ্ধ দ্বার নীতির পরিবর্তে পাশ্চাত্য বাণিজ্যের প্রতিপত্তি বিরোধক নীতি মনে করতেন। মধ্যযুগে আরব বণিকদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই ধরনের কঠোরতা আরোপ করা হয়েছিল।
7) ক্যান্টন বাণিজ্যে ইংলিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর একাধিপত্য লক্ষণীয়। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগের আগেই ইংরেজরা ক্যান্টন বাণিজ্যে অন্যান্য ইউরোপীয়দে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায়। অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্বে ক্যান্টন, ভারত এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে বাণিজ্যের দ্রুত বিকাশ হয়। ইংল্যান্ডে রপ্তানিজাত পণ্যাদির মধ্যে অন্যতম ছিল চা, রেশম, চীনা মৃৎপাত্র, বিরোচক ঔষধ, দারচিনি ইত্যাদি। চীনে ইংল্যান্ড থেকে আমদানি হত পশনবল, সীসা, টিন, লোহা, তামা, ফার (পশুর লোম), লিনেন এবং নানাবিধ খেলনা।
8) ভারতে ইংল্যান্ডের রপ্তানিজাত পণ্যাদির মধ্যে অন্যতম ছিল কার্পাস বস্তু (nankeen cloth), ফিটকিরি, কর্পুর, গোলমরিচ, সিঁদুর, চিনি, মিছরি, ঔষধপত্র ইত্যাদি এবং ভারত থেকে ইংল্যান্ডে যেত কাঁচা তুলো, আফিম, হাতির দাঁত, চন্দন কাঠ, রূপা ইত্যাদি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সনদপ্রাপ্ত জাহাজ পণ্যসত্তার নিয়ে চীনে পাড়ি জমাতো বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। ব্যক্তিগত মালিকানা ভিত্তিক ভারত ও চীনের মধ্যে এই বাণিজ্য “Country trade” বা দেশীয় ব্যবসা নামে পরিচিত ছিল। এই বাণিজ্যে অংশগ্রহণকারী বণিকদের মধ্যে ইংরেজগণই ছিল প্রধান। তাদের সঙ্গে কিছু ভারতীয় ও পার্শীও অংশ নিত। ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রচলিত ক্যান্টন বাণিজ্যের ৩০ শতাংশ ছিল। Country trade। এছাড়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর জাহাজের কর্মচারীরা কোম্পানীর অনুমতি সাপেক্ষে নির্দিষ্ট পরিমাণে সোনা এবং পণ্যদ্রব্য ক্যান্টনে নিয়ে এসে ব্যক্তিগত বাণিজ্য করতে পারত।
9) ইংল্যান্ডে চীনের চায়ের চাহিদা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলে অষ্টাদশ শতকের শুরুতে কোম্পানী কর্তৃক আমদানি করা চায়ের পরিমান দাঁড়ায় ৪,০০,০০০ পাউন্ড। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ক্রয় করা চায়ের মূল্য ছিল ২৩.৩ মিলিয়ন পাউন্ড যা ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দের পর বার্ষিক ২৬ মিলিয়ন পাউন্ডে গিয়ে দাঁড়ায়। চীনে চা উৎপাদনকারী ক্ষেত্রগুলি হল ফুকিয়েন (কালো চা), আনহেই (সবুজ চা) এবং কিয়াংসি (উভয় ধরনের চা)। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে কিছু ব্রিটিশ স্টীমার ফুচো থেকে ক্যান্টনে ১ মিলিয়ন পাউন্ড চা ১৩ দিনে বহন করত।
10) অষ্টাদশ শতকের শেষ দু দশকে Country trade বা দেশীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি পায় এবং চীনা বাণিজ্যে আমেরিকার অনুপ্রবেশ ঘটে। বাণিজ্য ক্ষেত্রে আমেরিকানরা ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্যের বিরোধী, মুক্ত বাণিজ্য বা free trade-এর সমর্থক। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে আমেরিকানদের দ্রুত বাণিজ্য বৃদ্ধি ঘটে যার ফলস্বরূপ তারা ইংরেজদের পরেই দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ আমেরিকানদের ৭টি সুপ্রতিষ্ঠিত ফার্ম ছিল এবং ২০ জন আমেরিকান নিয়মিত ক্যান্টনে আসত। এই বাণিজ্য ফার্মগুলি গোটা মার্কিন বাণিজ্যের দালাল (broker) রূপে কাজ করত। বয়ে নিয়ে আসা পণ্য বিক্রি এবং পণ্য রপ্তানি সবই তাদের কাজের আওতায় ছিল।
11) ক্যান্টন বাণিজ্যের অন্যতম লক্ষণীয় দিক হল এর একপেশে বাণিজ্যিক চরিত্র । চীনারা ইউরোপীয় পণ্যসামগ্রী চাইতনা, আর যেহেতু ইউরোপীয়রা চীনা পণ্যসামাগ্রী সংগ্রহের জন্য দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রা করত তখন চীনাদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মায় যে পাশ্চাত্য দেশগুলি তাদের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য তাদের উপরে নির্ভরশীল। অষ্টাদশ শতকে ক্যান্টন বাণিজ্যের বাণিজ্যিক ভারসাম্য তাই চীনাদের পক্ষে ছিল। বিদেশী পণ্যের প্রতি চীনাদের চাহিদা যেখানে অতি সমান্য ছিল পাশ্চাত্য বণিকেরা সেখানে বিপুল পরিমাণ চা, রেশম, বিরোচক ঔষধ, দারচিনি, চীনামাটির পাত্র ইত্যাদি কিনত) বিদেশী জাহাজগুলিকে চীনা পণ্য ক্রয়ের জন্য রৌপ্য বুলিয়ন আনতে হত।
12) ১৭৭৫ এবং ১৭৯৫-র মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর চীনে আমদানি করা পণ্য ও রৌপ্য বুলিয়নের মূল্য ছিল ৩১.৫ মিলিয়ন টেইল (tael) যেখানে চীন থেকে রপ্তানিজাত পণ্যর মূল্য ছিল ৫৬.৬ মিলিয়ন টেইল। কোম্পানীর এই ২৫.১ মিলিয়ন টেইল ঘাটতি অংশত “Country trade” এবং Private trade বা ব্যক্তিগত বাণিজ্যের দ্বারা মেটানো হত। তাছাড়া ক্যান্টন বন্দরে বিদেশী জাহাজের নোঙর করা ও পণ্য পরিমাপ থেকে চীনা সরকারের বিপুল আয় হত। একটি প্রথম শ্রেণীর জাহাজের ক্যান্টন বন্দর তিনমাস অবস্থানের জন্য ৪,৫০০ টেইল দিতে হত।