চীনের শত দিবসের সংস্কার আন্দোলনের পটভূমি ব্যাখ্যা কর । একশো দিনের সংস্কার আন্দোলনের পটভূমি।
১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চিন এক যুগসন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছিল। চিন-জাপান যুদ্ধে (১৮৯৪-৯৫) চিন চূড়ান্তভাবে পরাস্ত হয়। আত্মশক্তি বৃদ্ধি আন্দোলন জাপানি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে চিনকে রক্ষা করতে পারেনি। যুদ্ধের পর শিমনোসেকির সন্ধিতে জাপান চিনের ওপর যে ক্ষতিপূরণ চাপিয়েছিল তা ছিল চিনের রাষ্ট্রীয় আয়ের তিন বছরের সমান। অন্যান্য শর্তও ছিল সমান অবমাননাকর, চিনের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা বিপন্ন হতে বসেছিল। চিন-জাপান যুদ্ধ চিনের দুর্বলতা প্রকাশ করে দিলে পশ্চিমি রাষ্ট্র জার্মানি, ইংল্যান্ড, রাশিয়া ও ফ্রান্স চিনে নিজ নিজ প্রভাবাধীন অঞ্চল গড়ে তোলার কাজে মন দিয়েছিল।
১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে জার্মানি ফুচাও অধিকার করলে অন্যান্য বিদেশি রাষ্ট্রগুলি চিন ব্যবচ্ছেদের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে পড়েছিল ( Foreign powers moved towards dismem bering the empire cutting up the Chinese melon)। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও রাশিয়া নিজ নিজ অঞ্চলে স্বাধীনভাবে চলতে থাকে। চিনা বুদ্ধিজীবী, শাসকগোষ্ঠী ও সৈন্যবাহিনী সকলেই ধরে নিয়েছিল সংস্কার না হলে চিনের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে (China must progress or perish)। পিকিং দরবারে একটি নরমপন্থী সংস্কারক গোষ্ঠী ছিল, এদের নেতৃত্ব দেন ওয়েং টুং হো ও চ্যাং চি টুং। এই পর্বে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বিধবা রানি জু-সি। তিনি মাঞ্চু সেনাপতি জুং লু প্রাসাদের খোজা প্রধান লি-লিয়েন ইং-কে নিয়ে ক্ষমতাচক্র গড়ে তোলেন। রানি মধ্যপন্থী সংস্কারে আপত্তি করেননি, কিন্তু মৌল সংস্কার হলে তিনি ও তাঁর অনুচররা ক্ষমতাচ্যুত হবেন এমন সম্ভাবনা সব সময় ছিল।
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চিন ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছিল (The Ching empire in 1898 stood at a turning point in history)। সংস্কারকদের ফেং কুই ফেন প্রথম পশ্চিমি গণিতশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ভূগোল শিখে শিক্ষার সংস্কার করতে বলেন, প্রশাসনিক পুনর্গঠনের প্রস্তাব দেন, আর একজন সংস্কারক হলেন কুয়ো-সুং-টাং। তিনি প্রশাসন, আইন ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ওয়াং টাও সৈন্যবাহিনী, শিক্ষা, আইন ও বিচার ব্যবস্থার সংস্কার করতে বলেন।
চিনের প্রশাসক, বুদ্ধিজীবী, লেখক ও শিক্ষিত সম্প্রদায় সংস্কারের পক্ষে মত প্রকাশ করেছিল। চিনে আধুনিক শিল্প গড়ে উঠেছিল, কম্প্রাদর শ্রেণীর মানুষ পুরনো ব্যবস্থার সংস্কারের দাবি তুলেছিল। পুরোনো কনফুসীয় ব্যবস্থা আধুনিক শিল্পায়ন, পুঁজিবাদের বিকাশ ও অর্থনৈতিক প্রগতির পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছিল। বুদ্ধিজীবী চেং কুয়ান ইং ও হোচি বিদেশের অনুকরণে পার্লামেন্ট গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। চিনের প্রটেস্ট্যান্ট মিশনারিরা সংস্কারের অনুকূল পরিবেশ গঠন করে দেন। তাঁরা খ্রিস্টধর্ম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমি জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচারে সহায়ক হন। এঁরা পশ্চিমি ভাবধারার পক্ষে বক্তৃতা দেন, স্কুল ও মিউজিয়াম স্থাপন করেন এবং সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রিকা প্রকাশ করে সংস্কারের পক্ষে জনমত গঠন করেন। বিদেশিরা এবং তাদের অনুকরণে চিনারা অনেকগুলি আধুনিক সংবাদপত্র প্রকাশ করেন।
পিকিং দরবারে সম্রাটের শিক্ষক ওয়েং টুং হো এবং প্রাদেশিক শাসক চ্যাং চিং টুং সংস্কারের পক্ষপাতী ছিলেন কিন্তু তাঁরা মৌল পরিবর্তনের বিরোধী ছিলেন। এদের মূল বক্তব্য হল চিনা প্রথাগত শিক্ষা দেবে মৌল নীতি, বিদেশি শিক্ষা দেবে আত্মরক্ষার শক্তি (Chinese learning for the foundation. Western learning for application)। এরা ছিলেন পুরোনোপন্থী কনফুসীয় রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় বিশ্বাসী, এদের কনফুসীয় ব্যাখ্যাও ছিল পুরোনো ধরনের।
বিরোধী অগ্রগামী প্রগতিশীল গোষ্ঠী ছিল কাং ইউওয়ে, লিয়াং চি চাও, ইয়াং জুই, লিউ কুয়াংতি, লিন সু ও তানসু তুংদের নিয়ে গঠিত। এই গোষ্ঠী যথার্থ উপলব্ধি করেছিল চিনের পশ্চাৎপদতা ও সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণের যুগে চিনের অসহায়তা (They realized the backwardness of China and her dangerous position in the age of imperialism)। এরা কনফুসীয় মতবাদের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন যে কনফুসিয়াস নিজে পরিবর্তনের বিরোধী ছিলেন না। পরিবর্তন ও প্রগতি শুধু চিনকে বাঁচাতে পারে (finding in antiquity the sanction for present day changes)। ঐতিহ্যের মধ্যে তাঁরা পরিবর্তনের অনুমোদন খুঁজেছিলেন।
কাং লিখেছিলেন তা তুং সু নামক একখানি গ্রন্থ (The book of universal Commonwealth)। এই গ্রন্থে তিনি তাঁর সংস্কার কর্মসূচির আভাস দেন। এই গ্রন্থে একটি সাম্যবাদী কাল্পনিক রাষ্ট্রের ছবি এঁকেছিলেন তিনি। কাং সম্রাটের শিক্ষকের সহায়তায় তাঁর প্রতিবেদনগুলি দরবারে পৌঁছে দেন। প্রথমে তিনি চেয়েছিলেন শিমনোসেকির সন্ধি বাতিল করে সম্রাট যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কাজে হাত দেবেন। কাং ও তাঁর অনুগামীরা সংস্কারের দাবি হুনান, কিয়াংসু, কোয়াংটুং ও পিকিং-এ ছড়িয়ে দেন।
সারাদেশে অনেকগুলি ‘স্টাডি সোসাইটি’ গঠিত হয়। এসব সংস্থায় শিক্ষিত মানুষরা সংস্কারের দাবিকে চিনের জোরদার করে তোলেন, গঠিত হয় ‘চায়না রিফর্ম অ্যাসোসিয়েশন’। কাং সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে স্পষ্টভাবে চিনের দুর্গতি, মাঞ্চু বংশের ভবিষ্যৎ ও অস্তিত্বের কথা তুলে মোট আটটি আবেদন পেশ করেছিলেন।
১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ জুন থেকে সম্রাট কোয়াংসু সংস্কার সম্পর্কিত আদেশগুলি জারি করতে শুরু করেন, চল্লিশটির ওপর সংস্কার সংক্রান্ত আদেশ জারি করা হয়েছিল। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১০৩ দিন ধরে সংস্কারের কাজ চলেছিল, ইতিহাসে এই ঘটনাটি শতদিবসের সংস্কার নামে পরিচিত। কাং ইউ ওয়ে ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে শত দিবসের সংস্কার শুরু করেছিল । ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর শত দিবসের সংস্কার হয়। ২১ সেপ্টেম্বর সম্রাট বন্দি হন, কাং পালিয়ে যান। এই সংস্কার আন্দোলনের মডেল ছিল রুশ সম্রাট মহামতি পিটার ও জাপানের মেজি সম্রাট।
কাং-এর প্রস্তাব অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার বারোটি দপ্তরে বিভক্ত হয়, বারোটি দপ্তরের প্রধানরা মিলে আধুনিক ক্যাবিনেটের মতো সরকার গঠন করেন। প্রদেশ ও জেলাতেও অনুরূপ শাসন কাঠামো গঠনের ব্যবস্থা হয়। প্রদেশ ও জেলাগুলিতে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। দেশের সরকারি পরীক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো হয়, আইন বিধির সংস্কার করা হয়। পিকিং-এ একটি পার্লামেন্ট স্থাপনের প্রস্তাব ছিল, কাং নির্বাচিত আইন সংসদ গঠনের কথা বলেন।
কাং পশ্চিমি রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুকরণে সরকারের তিন বিভাগ—–—শাসন, আইন প্রণয়ন ও বিচার বিভাগের পৃথকীকরণের কথা বলেছিলেন। কার্যত কাং পুরোনো ধরনের কনফুসীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তে আধুনিক নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র স্থাপনের কথা বলেছিলেন। কাং কর্মহীন অথচ বেতনভোগী পদগুলি (abolition of unnecessary and sinecure offices) তুলে দিতে বলেন। হুপে, কোয়াংটুং ও উনানের গভর্নরের পদ তুলে দেওয়া হয়। এধরনের আরও অনেকগুলি কর্মহীন উচ্চপদ উচ্ছেদ করা হয় (যেমন শস্য পরিবহন আধিকারিক, লবণ আধিকারিক ইত্যাদি) (সরকারি পদে শুধু প্রগতিশীলদের নিয়োগের ব্যবস্থা হয়।
সরকারি কাজে গতি সঞ্চার করার অন্য পদ্ধতি সরলীকরণের ব্যবস্থা হয়েছিল, দুর্নীতি দুর করার জন্য প্রতিরোধমূলক সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জনসাধারণকে সরকারি কাজের উন্নতির জন্য প্রস্তাব দিতে বলা হয়।। শিক্ষার ক্ষেত্রে শতদিবসের সংস্কার পর্বে অনেকগুলি পরিবর্তন ঘটানো হয়। পুরোনো সরকারি পরীক্ষার পরিবর্তে আধুনিক ঘটনাবলীর ওপর নির্ভর করে নতুন পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। জুন মাসে পিকিং-এ একটি বিশ্ববিদ্যালয়।
স্থাপন করা হল। প্রদেশে প্রদেশে চিনা ভাষা, সংস্কৃতি ও পশ্চিমি জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষাদানের জন্য স্কুল স্থাপনের কাজ চলেছিল জেলাগুলিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়, পরিত্যক্ত মন্দির ও দেবালয়গুলিতে বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। বিদেশি জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষাদানের জন্য পৃথক বিদ্যায়তন গঠন করা হয়। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটি মেডিকেল স্কুল স্থাপন করা হয়। সরকারি উদ্যোগে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়।
রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ওপর একটি বিশেষ পরীক্ষা নেবার ব্যবস্থা হয়েছিল। সংস্কার পর্বে পুরোনো প্রথা বাতিল করে মাধুদের বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়া হয়। রেলপথের সম্প্রসারণ ঘটানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। সরকার কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের উন্নতির জন্য প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। সরকার বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের নতুন কোনো আবিষ্কারের জন্য পুরস্কার দানের নীতি ঘোষণা করেছিল। রাজধানী পিকিং শহরকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার জন্য পরিকল্পনা গৃহীত হয়। সরকার সরকারি কর্মচারীদের বিদেশে পাঠিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার কথা বলেছিল। মিশনারিদের রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সরকার দেশের জটিল আইনবিধি সহজ, সরল করে প্রচার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সর্বোপরি, সরকার আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সমতা রক্ষার জন্য বাজেট তৈরির ব্যবস্থা করেছিল।