StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

কালীঘাটের পট সম্পর্কে লেখ

 

কালীঘাটের পট সম্পর্কে লেখ । টীকা লেখ কালীঘাটের পট ।

দেশজ রীতির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ লক্ষ্য করা যায়, কলকাতার কালীঘাট ও বটতলার পটে। কালীঘাটের চিত্রকররা ছিলেন জাতে পটুয়া (আদিতে সুত্রধর)। তাদের পূর্বপুরুষদের জাত ব্যবসা ছিল কাঠের কাজ ও মন্দির ইত্যাদি নির্মাণ; এরপর আসে মাটির প্রতিমা গড়া। মাটির প্রতিমা গড়ার ঋতু উত্তীর্ণ হলে তারা পট আঁকতেন; খেলনা, মাটির ও কাঠের পুতুল তৈরি করতেন। কড়া, দৃঢ় চিত্রিত রেখা আঁকার ক্ষমতা তারা পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। কিন্তু শিক্ষা, চেতনা ও উৎসাহের অভাবে এই উত্তরাধিকার নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তথাপি ব্যঙ্গচিত্রে তারা ফুটিয়ে তোলেন অসাধারণ নৈপুণ্য, পটুত্ব ও কৌশল। প্রতিমা গড়ার অভ্যাসের জন্য তাদের ছবিতে আসে মডলিং ও ফোরশর্টনিং-র লক্ষণ, পার্থিব মাটির ওজন ও গুণ ও সেই সঙ্গে স্থূলত্ব। এই পটে থাকত বোম্বাই-আমেদাবাদের মত রেখার ব্যঞ্জনা; এতে গভীরতা ছিল কম।

রেখার নক্সা আঁকার পর পরিচারিকারা অপটু হাতে এগুলির উপর স্বচ্ছ রঙের প্রলেপ ‘টিন্ট’ প্রদান করতেন। ফলে রঙ প্রায়ই রেখা থেকে বেরিয়ে যেত। সচেতনভাবে করা হলে এইধরনের রঙ বিশেষ অভিব্যক্তির ব্যঞ্জনা আনে। কিন্তু এরা বিদেশী ছবি দেখলেও পাটনা, লক্ষ্ণৌ বা তাঞ্জোরের শিল্পীদের মত কোম্পানির শিল্পী ছিলেন না। তাদের দৃষ্টিতে ও কাজে যে অবক্ষয় ও অবনতি আসে তার জন্য দায়ী ছিল তৎকালীন সমাজের রুচি ও শিক্ষার অরাজকতা।

ডব্লু. জি. আর্চার-র ‘বাজার পেন্টিংস অফ্ ক্যালকাটা’ গ্রন্থে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নিরবরণ চন্দ্র ঘোষ, কালীচরণ ঘোষ, নীলমনি দাস, বলরাম দাস, গোপাল দাস প্রমুখ পটুয়ার নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। কালীঘাটের ছবির জগতের (স্কুলে) জন্মকালে ইঙ্গ-ভারতীয় চিত্ররীতির প্রভাব প্রবলভাবে আসলেও তা শিক্ষানবিশির ফল ছিল না, ছিল দূর থেকে দেখা। ফলে কালীঘাটের পটুয়ারা ব্রিটিশ টেকনিক আত্মসাৎ করতে গিয়ে কতগুলি মোটা লক্ষণ গ্রহণ করেন বলে আর্চার মন্তব্য করেছেন। আর্চারের এই মন্তব্যকে শিল্প বিশেষজ্ঞ অশোক মিত্র আবার সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন কালীঘাটের পটে কিছু বিদেশী আখ্যান বিষয়বস্তু বা পোষাক-পরিচ্ছদ আসলেও তাদের অঙ্কনরীতি কখনোই পাটনাই বা কোম্পানি-রীতি হয়ে যায়নি—ছিল নিতান্তই দেশীয়, বাঙালি। বরং ঊনিশ শতকের শেষার্ধে চোরাবাগানের শিল্পীদের ছবিতে ও বউবাজারের আর্ট স্টুডিও-তে ইলাস্ট্রেশন জাতীয় কাজ লক্ষ্য করা যায়। 

কালীঘাটের পটুয়া সমাজের ক্রেতা (প্রভু) ছিল সাধারণ বাংলার সমাজ। ফলে বেলা পট, গাজীর পট, প্রতিমা মুর্তি, পীরের ঘোড়া, শিশুদের সস্তার খেলনা, বাড়ির দেবদেবীর পট এগুলি থেকেই তাদের শিল্পকর্মের রসদ তারা খুঁজে নিয়েছিলেন। শিক্ষা, চেতনা ও অনুশীলনের অভাবে তাদের রূপদৃষ্টি আবৃত হয়ে পড়লেও চিত্রের নিয়ম-ছন্দ বজায় ছিল। কালীঘাটের পটের রেখার আকৃতি, ডিজাইন, রঙ নির্বাচন, তুলির টান সবই ছিল প্রতিমা শিল্পীদের উত্তরাধিকার, মাটির প্রতিমার মতই কালীঘাটের পটে তাই ফুটে ওঠে নিশ্চল, স্থির স্তব্ধতা। পুনারাবৃত্তির কারণে সেগুলিতে মোটা তুলিতে অবহেলায় সমান উজ্জ্বল রঙের প্রাবল্য লক্ষ্য করা যায়। দ্রুত ছবি শেষ করার তাগিদে সরল রীতির আবির্ভাব ঘটে।

কালীঘাটের পটচিত্রের বিষয়বস্তুর মধ্যে ধর্মীয় ভাবাবেগের একটা চোরাস্রোত থাকলেও জাতি-ধর্ম-বর্ণের সংহতি এর মধ্যে বিদ্যমান ছিল এবং বিষয়বস্তু ছিল অনেক বহুমুখী এবং সৃজনশীলতায় পরিপুষ্ট। এখানে রামের বনবাস, মনষা ভাসান, শিব-পার্বতীর আখ্যান, নিমাই সন্ন্যাসী, সত্যপীরের কথা, গাজীর উপাখ্যান, কৃষ্ণলীলা, রামায়ণের কাহিনী, জাতকের গল্প ইত্যাদির চিত্ররূপ যেমন দেখা যায় তেমনি এর পাশাপাশি ফুলবাবু, পটের বিবি, বাদশা বেগম, মেম-সাহেবের নৃত্যলীলা, মাছকুটনি, জ্বলোবেড়াল, ফসল কাটা সহ বিভিন্ন রঙ্গ-ব্যঙ্গাত্মক চিত্রের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। এই চিত্রকলায় রাজস্থানী, জয়পুরী, কাংড়া চিত্ররীতির প্রভাবসহ মুঘল আমলের মিশ্র চিত্ররীতির অনুপ্রবেশ লক্ষ্য করা যায়। তবে পাশ্চাত্যের উগ্র চিত্ররীতি কোনোভাবেই কালীঘাটের পটচিত্রের স্বকীয়তাকে ক্ষুন্ন করতে পারেনি।

কালীঘাটের পটচিত্রের শিল্পীরা (পটুয়া) বাজারের সম্ভা কাপড় কিনে তার উপর পেনসিল দিয়ে ড্রয়িং করে রঙের কাজ শুরু করত। পটে বর্ণ নির্বাচন ও তার প্রয়োগ ছিল একান্তই তাদের নিজেদের রীতি অনুসারী। প্রথমে খুব মোটা করে ড্রইং-র বাইরের জমি বরাবর রঙ ভরে নিয়ে তারপর অপেক্ষাকৃত গাঢ় বা হালকা উজ্জ্বল রঙের মিশ্রণ দিয়ে ড্রইং বরাবর রঙ ব্যবহার করা হত। বর্ণ থেকে বর্ণাত্তরে ও ড্রইং-র বিশেষ ভাঁজে কালো অথবা অনুরূপ ভারী রঙের ব্যবহার পটচিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। এইধরনের ছবিতে ব্যবহৃত রঙ ছিল নিম্নমানের। বাজারের মেটে সিঁদুর, ঘর রঙ করার হালকা নীল অথবা গুটি নীল, পিউরি (হলুদ), সস্তা এ্যালামাটি, গিরিমাটি, আলতা, ভূযাকালি, পাথুরে সবুজ ইত্যাদি ও একাধিক রঙ মিশিয়ে মিশ্র রঙের ব্যবহার এই চিত্র প্রকরণের অগ্রগণ্য অভ্যাস ছিল।

কালীঘাটের পটে আলোছায়া ও পরিপ্রেক্ষিতের ব্যবহার নেই। তবে মূল রঙের সাথে সাদা রঙ মিশিয়ে টেম্পারা রঙের প্রয়োগ খুবই প্রচলিত। কালীঘাটের পটের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল রেখা ও বর্ণপ্রয়োগের অনুপম সাবলীলতা। এছাড়াও ‘মোটা রঙের গোটা কাজ’—কালীঘাটের পটচিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল।

বাংলাদেশের অন্যত্র হিন্দু-মুসলমান পটুয়ারা গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে, গান গেয়ে জড়ানো পট দেখাতেন। এইসব জড়ানো পটের সঙ্গে মুঘলরীতির মিল ছিল না; মিল ছিল দাক্ষিণাত্য ও উড়িষ্যার প্রাচীন রীতির। এই চিত্ররীতিতে সমান, ফ্ল্যাট জমিতে দ্বিমাত্রিক অলঙ্কারময় চিত্রে পরিপ্রেক্ষিতের অভাব ছিল। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মাটির প্রতিমার অনড় ‘মডেলিং’ শৈলী। প্রতিমার মত পটেও বিপরীতধর্মী সামান্য কয়েকটি রঙের সাহায্যে ছবির আসল ফর্ম ও ছন্দ ফুটিয়ে তোলা হতে থাকে। তবে জড়ানো ও কালিঘাটের পটে উভয়ের মধ্যে রঙের ব্যবহার ও রেখাতে তফাৎ থাকলেও কোনোটাই ‘কোম্পানি শৈলী’-র ছবি ছিল না।

১৮৩০ সাল পর্যন্ত কালীঘাটের পটে দেবদেবীর ছবি বেশি। ১৮৩০ সালের পর বিদেশী পোশাক-পরিচ্ছদ, আদব-কায়দা সম্পর্কে ব্যঙ্গ ভরা উৎসাহের পাশাপাশি ভলিউমের প্রতি ঝোঁক চলে গিয়ে রঙের টোনের প্রতি উৎসাহ দেখা যায়। ১৮৭০-১৯০০ সাল এবং তারও পরে কালীঘাটের পট হয়ে ওঠে পুরাণ ও দৈনন্দিন জীবননির্ভর এবং আধুনিক ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজের ব্যাভিচারের বিরুদ্ধে সামাজিক শ্লেষ বিদ্রুপের হাতিয়ার; মূমূর্ষু পুতুলের সংসারের আখ্যানে শিল্পীর নিজস্ব মন মৃতপ্রায়। যেটুকু প্রাণশক্তি লক্ষ্য করা যায়, তা ছিল মুমূর্ষু অবস্থার প্রতিবাদে আত্মঘোষণার পরিণতি। ১৯০০-১৯৩০ সালের মধ্যে কালীঘাটের পটের রীতি আরও সংক্ষিপ্ত, সাধারণ, আড়ষ্ট ও প্রাণহীন হয়ে পড়ে। অবশেষে জার্মানীর সস্তা ‘ওলিওগ্রাফ’ এসে এই রীতিকে একেবারেই নষ্ট করে দেয়।

Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *