StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

চিত্রকলার ইতিহাসে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান

চিত্রকলার ইতিহাসে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান সংক্ষেপে আলোচনা করো।





ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপর্ব থেকে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত যখন ভারতীয় চিত্রশিল্প পাশ্চাত্যের দাপটে অতিমাত্রায় প্রভাবিত তখন রাজা রবিবর্মা ছাড়া প্রাচ্যের শিল্পজগতে যাঁরা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অন্যতম।




১৮৬৭ সালে ১৮ সেপ্টেম্বর কলকাতার জোড়াসাঁকো বিখ্যাত ঠাকুরবাড়িতে গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। তাঁর পিতার নাম ছিল গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতার নাম ছিল সৌদামিনী দেবী।




বাল্যকালে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে শিক্ষালাভের সময় তাঁর চিত্রাঙ্কনের হাতেখড়ি হলেও চারুকলা চর্চার সঙ্গে তাঁর সেভাবে যোগাযোগ তখনছিল না। ভ্রাতা অবনীন্দ্রনাথ শিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করার অনেক পরে তিনি চারুকলা অনুশীলন শুরু করেন। জাপানী শিল্পশাস্ত্রজ্ঞ ওকাকুরার সাথে আগত ইওকোয়াইমা টাইকান, যোশিও কাৎসুটা ও হিষিরা সুনসো নামক তিনজন জাপানী শিল্পী ১৯০২-০৩ সাল নাগাদ ঠাকুরবাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেন। এই জাপানী শিল্পীদের দ্বারা তিনি চিত্রাঙ্কনে আকৃষ্ট হন এবং সরকারি আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ হরিনারায়ণ বসুর কাছে বাড়িতে চিত্রবিদ্যা অনুশীলন শুরু করেন।




চাইনিজ কালি ও তুলির সাহায্যে কতগুলি কাকের চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে তাঁর চিত্ররচনা পর্বের শুরু। পরবর্তী সময়ে তাঁর চিত্রগুলি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত ছিল। কাক সিরিজের প’র তিনি মুখচ্ছবি রচনার প্রতি আকৃষ্ট হন। কালি ও তুলির সাহায্যে অঙ্কিত তাঁর প্রতিকৃতি চিত্রের অধিকাংশই ‘প্রোফাইল’। ছায়ার মত ‘সিলুয়েট’ পদ্ধতিতে রচিত তাঁর নিজের সুপরিচিত মূর্তিটি এইপর্বেরই রচনা। এরপর রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন-স্মৃতি’ গ্রন্থের চিত্রাঙ্কন তাঁর চারুকলা চর্চার উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। কালি ও তুলির সাহায্যে অঙ্কিত ‘জীবন-স্মৃতি’-র চিত্র সংখ্যা ২৪।




গগণেন্দ্রনাথ পরবর্তী পর্বে হিমালয়, পুরীর ও রাঁচীর দৃশ্যচিত্র এবং চৈতন্যলীলার রূপায়ণে উদ্যোগী হন। ওয়াশ পদ্ধতি’-তে অঙ্কিত এই সিরিজগুলির অন্যতম হিমালয়ের চিত্রাবলীতে হিমালয়ে ধ্যান গম্ভীর রূপের সঙ্গে আকাশ, মেঘ, তুষার ও অরণ্যের রূপগুলিও ধরা পড়ে। পুরী ও চৈতন্য সিরিজের চিত্রাবলীর রচনাকাল ১৯২০ সালের পরবর্তী সময়। অলঙ্কার বর্জিত এই চিত্রগুলির মাধ্যমে শিল্পীর বৈরাগী মনের অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। চৈতন্যলীলার চিত্রগুলির মাধ্যমে নবদ্বীপের যে পরিবেশ সৃষ্টি হয় তাতে পল্লী বাংলার রূপটি সহজলভ্য। রাঁচী সিরিজে চিত্রগুলি এসময় রচিত হলেও কিছুটা ভিন্ন ধরনের। রাঁচীর দৃশ্যাবলীতে উজ্জ্বল রঙের আধিক্য তার অন্য ধরণের চিত্রচিন্তার অভিনব পরিণতি।




গগণেন্দ্রনাথের শিল্পীমানসের সবচেয়ে বৈচিত্রপূর্ণ বিকাশ লক্ষ্য করা যায় ‘কল্পলোক’ (fantacia) সিরিজের ছবিগুলিতে। এগুলিকে কেউ কেউ ‘কিউবিক’ চিত্রকলা বলে অভিহিত করলেও তা সঠিক নয়। চতুষ্কোণ, বৃত্ত, অর্ধবৃত্ত, ত্রিভুজ এবং আলো ও অন্ধকারের সাহায্যেরচিত ‘কল্পলোক’ সিরিজে তিনি রহস্য ও রোমাঞ্চের সঙ্গে রূপকথার এক অনির্বচনীয় রঙ্গলোকের সমন্বয় ঘটান। এই চিত্রগুলির মধ্য দিয়েই গগণেন্দ্রনাথের শিল্পীসত্ত্বার চরম বিকাশ লক্ষ্য করা যায়।




সুকুমার চিত্রাঙ্কনের সঙ্গে ব্যঙ্গ-চিত্রকলাতেও গগণেন্দ্রনাথ পারদর্শীতার পরিচয় রাখেন। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপলক্ষ্য করে তিনি ব্যঙ্গ-চিত্র অঙ্কন করেন। 




গগণেন্দ্রনাথের ‘দাদাভাইয়ের দেয়ালা’ নামক শিশুদের উপযোগী একটি রচনা ১৯৩৩ সালে স্বচিত্র বার্ষিক বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁর মৃত্যুর পর রচনাটি গ্রন্থাকারে ‘ভোঁদড় বাহাদুর’ নামে প্রকাশিত হতে থাকে।




গগণেন্দ্রনাথের উল্লেখযোগ্য প্রতিকৃতি চিত্রগুলি ছিল—রচনানিরত রবীন্দ্রনাথ (১৩১৭ বঙ্গাব্দ), হরিনারায়ণ বসু, কংগ্রেস অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ (১৯১৭), ড. আনন্দ কুমারস্বামী, দ্বিজেন্দ্রনাথ, ওকাকুরা, রদেনস্টাইন, পিয়ারসন, দীনেশচন্দ্র সেন, অবনীন্দ্রনাথ প্রমুখের।




চারুকলার অগ্রণী পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গগণেন্দ্রনাথ স্মরণীয় হয়ে আছেন। বাঙালী শিল্পীদের চারুকলা সংস্থা ‘বঙ্গীয় কলা সংসদ’ গঠিত হওয়ার পর তাঁর বাড়িতেই এই সংস্থার অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় (১৯০৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর)। দু’বছর পরে গঠিত ‘ইণ্ডিয়ান সোসাইটি অফ্ ওরিয়েন্টাল আর্ট’-রও (১৯০৭ সালের এপ্রিল মাস) তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। সোসাইটি প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরে প্রত্যেক সদস্যের গৃহে ঘরোয়া সম্মিলনীর মাধ্যমে চিত্র প্রদর্শনীর রীতি ছিল। এই রীতি অনুযায়ী সি. এফ. লারমর, স্যার জন জর্জ উত্তরফ, ডাণ্ডলে. বি. মেয়ারস-র পরে গগণেন্দ্রনাথের আহ্বানে তাঁর বাড়িতে ‘ইণ্ডিয়ান সোসাইটি অফ্ ওরিয়েন্টাল আর্ট’-র চতুর্থ সম্মিলনী আয়োজিত হয় (১৯০৭ সালের জুলাই)।




১৯১৫ সালে হিন্দুস্থান বিল্ডিংয়ে যখন ‘ইণ্ডিয়ান সোসাইটি অফ্ ওরিয়েন্টাল আর্ট’-র চারুকলা শিক্ষাকেন্দ্রের উদ্বোধন হয়, তখন তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর পরিচালনায় এই চারুকলা অনুশীলন কেন্দ্রের প্রভূত শ্রীবৃদ্ধি সাধিত হয়।



ভারতী, প্রবাসী, মডার্ন রিভিউ, যমুনা, বঙ্গবাণী, ইণ্ডিয়ান ইফ প্রভৃতি সাময়িক পত্রে গগণেন্দ্রনাথের চিত্র প্রকাশিত হয়। ইণ্ডিয়ান মিউজিয়াম, সালার জং মিউজিয়াম, ন্যাশনাল গ্যালারি অফ্ মডার্ন আর্ট, ভারত কলাভবন (বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়), কলাভবন (শান্তিনিকেতন) এবং লাহোর সেন্ট্রাল মিউজিয়ামে গগণেন্দ্রনাথের চিত্র সংগৃহীত আছে। ১৯৩৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রায় ৭১ বছর বয়সে গগণেন্দ্রনাথ পরলোক গমণ করেন। চিত্রকলার ইতিহাসে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।










Share

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *