StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

জিমি – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ

 

জিমি

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ 

– গল্প

ভোঁদড়কে কোথাও উদবেড়াল, আবার কোথাও জলবেড়াল বলা হয়। এর একটা বড়ো কারণ, ভোঁদড় বেড়ালের মতনই মাছ খেতে খুব ভালোবাসে। কিন্তু ভোঁদড় যে পোষ মানে আমি জানতুম না। বনের যেখানে আমার আড্ডা অর্থাৎ কাঠের একটা বাংলোবাড়ি, তার পিছনে পাহাড়ি নদী আছে। ওখানটায় নদী বেঁকেছে। আর বাঁকের মুখে অতল জলের দহ। কোনো স্রোত নেই। ঝকঝকে কালো জল। তলা অব্দি পরিষ্কার দেখা যায়। ওই জলে ছিপ ফেলে মাছ ধরা আমার নেশা ছিল। শরৎকালের এক সকালে ছিপ হাতে গিয়ে দেখি, বিশাল বট গাছের শেকড়ে একটা বড়ো মাছের মুড়ো আটকে রয়েছে। আশেপাশে কয়েক টুকরো কাঁটাও দেখতে পেলুম। শেকড়টা যেখানে জলে নেমেছে, সেখানে চোখ পড়তেই  মনে হল কী একটা লুকোবার চেষ্টা করছে। আমার চোখে পুবের সূর্য নদীর তলায় প্রতিফলিত হয়ে জলে ঠিকরে পড়ছিল। তাই তক্ষুনি বুঝতে পারলুম না ওটা কী। মাছটা যে ভোঁদড়েই মেরেছে, তা বোঝা গেল। হয়তো এখনও খাচ্ছিল, আমি

এসে পড়ায় লুকিয়ে গেছে ঝোপে। তাই একটু তফাতে ছিপ ফেলে বসলুম। কিন্তু একটা চোখ রাখলুম সেদিকে। শেকড়ের তলায় যেটা নড়ছিল, সেটা কী, এতক্ষণে বুঝলুম। সেটা একটা পাইথন— যাকে বলে অজগর সাপ। আমি জানতুম, সাপটা বটের তলায় কোনো একটা গর্তেই থাকে। মাঝে মাঝে জলে ওর মাথা দেখতে পেতুম। কিন্তু আমার সাড়া পেলেই লুকিয়ে পড়ত।

এখন দেখি সাপটা সাবধানে এবার শেকড় বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কী ব্যাপার? ভোঁদড়বাবাজির এঁটো খাবে নাকি? মাছের মুড়োটা আন্দাজ কিলো দুইয়ের কম নয়। সাপটার সকালের খাওয়াটা ভালোই হবে মনে হল। কিন্তু অতবড়ো মাছ যে মেরেছে, সেই চতুর ও শক্তিমান শিকারিকে দেখতেই আমার লোভ হচ্ছিল বেশি।

সাপটা যেভাবে এগোচ্ছিল, আমার হাসি পাচ্ছিল। অত সাবধান হওয়ার কারণ

কী? ওই তো পেট ভরাবার মতন চমৎকার সুস্বাদু খাবার। মুখ বাড়ালেই পেয়ে যাবে।

পরক্ষণেই আমাকে চমকে দিয়ে গাছের ওপর থেকে কী একটা ঝাঁপ দিল। তারপর সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড শুরু হল। ফোঁস ফোঁস – খক্ র… খাঁক খর্…! ঠাহর করে দেখি, হ্যাঁ — সেই শিকারি ভোঁদড়টাই বটে। ভোজে ভাগ বসানো সে একেবারে বরদাস্ত করতে রাজি নয়।

রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে তখন। দু-জনে লড়তে লড়তে কখনো ঝোপের দিকে এগোচ্ছে। আবার পিছিয়ে জলের দিকেও চলে আসছে। আমার ভয় হল, ভোঁদড়টা যদি বোকা হয়, তাহলে অজগরটার ফন্দি টের পাবে না—জলে নেমে আসবে। কিন্তু এখন আমার করার কিছু নেই। হঠাৎ গাছ থেকে আবার কী একটা ঝুপ করে পড়ল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলুম না। অতটুকু খুদে একটা বাচ্চা ভোঁদড় বুঝি এতক্ষণ চুপচাপ বসে সব লক্ষ করছিল। এতক্ষণে মায়ের বিপদ আঁচ করে মায়ের পাশে দাঁড়াতে এল। বড়ো ভোঁদড়টা যে মাদি, তা বোঝা যাচ্ছিল। আমার খুব ভালো লেগে গেল ওই বাচ্চাটার এই মাতৃভক্তি এবং মরিয়াপনা। বার বার দু-পাশে লাফিয়ে লাফিয়ে সে সাপটার গায়ে কামড় বসাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সাপটা প্রকাণ্ড লেজ তুলে তাকে পালটা আক্রমণ করতেই সে ভড়কে গেল।

ইতিমধ্যে সাপটা বড়ো ভোঁদড়টাকে প্রায় জলের মধ্যে এনে ফেলেছে। হঠাৎ যেই বড়ো ভোঁদড়টা বোকার মতন সাপের মাথা লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল, অমনি গিয়ে জলে পড়ল। সাপটা যেন এই সুযোগই খুঁজছিল। তার লম্বা বিকট মাথাটা বোঁও করে ঘুরে জলে ডুবতে দেখলুম। তারপর জলের গভীরে সে কী আলোড়ন। বাচ্চাটা তখন জলের ধারে প্রায় দু-পায়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। বেচারার অসহায় অবস্থা দেখে খুব মায়া হল।

সেই সময় সাপটা এতক্ষণে জল থেকে মাথা তুলল। এবার আমার মাথার চুল শিরশির করে উঠল। বড়ো ভোঁদড়টার মুণ্ডু কামড়ে ধরেছে সাপটা। ওই অবস্থায় সে আবার ডুবল। কিছু দূরে যখন মাথা তুলল, দেখি তখনও মাথা কামড়ে ধরে ভোঁদড়টাকে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হল ওপারের পাথরের খাড়ির মধ্যে কোনো গর্তে ঢুকে জন্তুটাকে গিলে খাবে। রাগে-দুঃখে আমি কাঁপতে থাকলুম। কিন্তু বুদ্ধির ভুলে সঙ্গে বন্দুক আনিনি। কী আর করব? পাথর ছুড়ে হয়তো লড়াই থামাতে পারতুম। কিন্তু সারাক্ষণ ব্যাপারটা হাঁ করে শুধু দেখে গেছি। ভাবতেই পারিনি যে একটা সাংঘাতিক কাণ্ড এ-থেকে ঘটতে পারে।

বেচারা মাতৃহারা খুদে ভোঁদড়টাকে আর দেখতে পেলুম না। মাছধরা রেখে ওকে সে বেলা খুব খোঁজাখুঁজি করলুম। কিন্তু তার পাত্তাই নেই। তারপর কয়েকটা দিন ওখানে মাছ ধরতে গেছি। দূর থেকে সাপটাকে অনেক

বার মাথা তুলতে দেখেছি, কিন্তু খুদে বেচারার পাত্তা নেই। একদিন মাথায় বুদ্ধি খেলল। একটা ফাঁদ পেতে ওকে ধরা যায় কি না ভাবলুম। আমার মনে হচ্ছিল, কবে না ও বেচারাও রাক্ষুসে অজগরটার পাল্লায় পড়ে যায়। তা ছাড়া অত ছোটো প্রাণী, এখনও কি নিজের গায়ের জোরে শিকার ধরতে শিখেছে? ও হয়তো না। খেয়েই মারা যাবে?

একটা ফাঁদের খাঁচা তৈরি করে জলে কিছুটা ডুবিয়ে রাখলুম। খাঁচার ভেতরে রাখলুম একটা মাছ। তারপর দূরে বসে পাহারায় থাকলুম।

সেদিনই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাচ্চাটা বার তিনেক এল। জলের ধারে ধারে ঘুরঘুর করল। মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে চমকে দৌড় দিল ঝোপের দিকে। চার বারের বার সোজা খাঁচার দিকে চলে গেল সে এবং মাছটা ধরতে গিয়েই আটকে গেল ফাঁদে।

এভাবেই ‘জিমি’ আমার বাড়ির অতিথি হয়ে এল এবং তারপর রীতিমতো ভদ্র সভ্য চমৎকার একটি প্রাণী হয়ে উঠল। স্বাস্থ্যও হয়ে উঠল অপূর্ব।

এক মাস পরে দেখলুম ছেড়ে দিলেও জিমি পালাবার নাম করে না। আমার কুকুর জ্যাকির সঙ্গে ওর দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে যখন জ্যাকিকে নিয়ে শিকারে যাই, জিমির সে কী ছটফটানি! কিন্তু তাকে সঙ্গে নিতে ভয় পাই – ওকে তো জ্যাকির মতন ডাঙার জন্তু শিকারের শিক্ষা দেওয়া হয়নি। বড়ো জোর ছিপে মাছ ধরার সময় ওকে সঙ্গে নেওয়া যায়। তবে নদীর দহে ওকে নিয়ে যাচ্ছি না। শয়তান অজগরটা রয়েছে। ওটাকে অবশ্য মেরে ফেলা যায়। কিন্তু কষ্ট হয়। আহা, বুড়ো হয়ে কতকাল বেঁচে আছে সে। ওর ভয়েই তো এদিকে জেলেরা কেউ মাছ ধরতে আসে না। নয়তো করে দহের মাছ শেষ হয়ে যেত। ফলে জিমিকে বাঁচানো যেত না। মাছের অভাবে।

তখন বেশ শীত এসে গেছে জাঁকিয়ে। ঘন কুয়াশায় বন সকাল-সন্ধ্যা ধূসর হয়ে থাকে। সন্ধ্যায় আগুন জ্বেলে জ্যাকি আর জিমিকে নিয়ে বসে থাকি। সকাল সকাল শুয়ে পড়ি। সারারাত নিঝুম বনে শীতেকাতর জন্তুজানোয়ার ডেকে ওঠে। জ্যাকি ও জিমি কম্বলের তলায় শুয়ে নাক ডাকায়।

হঠাৎ একরাত্রে ঘুম ভেঙে গেল। কেন ভাঙল বুঝতে পারলুম না। কিন্তু পরক্ষণেই জ্যাকি খুব গরগর করতে থাকল। টর্চ জ্বেলে দেখি জ্যাকি কোনার দিকে মেঝেয় ঝুঁকে গর্জাচ্ছে। উঠে গেলুম। তারপর আমি তো বোকা বনে তাকিয়ে রইলুম। ওরে দুষ্টু! এত ধুরন্ধর হয়েছ তলায় তলায়! সিঁদ কাটতেও শিখে গেছ!

আমার এই ঘরটা মাটি থেকে সাত ফুট উঁচুতে— মেঝেয় কাঠের পাটাতন। ওই কোনার একজায়গায় কীভাবে ফাটল ধরেছিল এবং পেরেকগুলোও ছিল মরচে পড়া। তাই সাবধানতার জন্যে একটা ড্রাম রেখেছিলুম ওখানে। জিমি করেছে কী, ড্রামটার তলায় কবে কবে পেরেক ছাড়িয়ে কাঠ সরিয়েছে। একটা কাঠের তত্ত্বা ঝুলে গেছে নীচে। আর সে সেই ফাঁক গলিয়ে কোথায় পালিয়েছে।

রাগে-দুঃখে অস্থির হলুম। কিন্তু এই শীতের রাতে আর কী করা যাবে? জ্যাকিকে খুব ধমক লাগালুম। কেন সে আগে আমাকে জানায়নি? জ্যাকি খুব দুঃখিত মুখে তাকিয়ে থাকল। মনে হল, সেও ব্যাপারটা তলিয়ে দেখেনি। কিন্তু গেল কোথায় জিমি এত রাতে? পালাবার হলে তো দিনে যেকোনো সময়

পালাতে পারত।

শুয়ে এইসব ভাবছি, হঠাৎ ড্রামটা নড়ে উঠল। টর্চ জ্বেলে দেখি—হ্যাঁ — শ্ৰীমান ফিরছে। কিন্তু ও কী, জিমি কী একটা টেনে তোলার চেষ্টা করছে তলা থেকে। টর্চের আলোয় ওর নীল চোখে পালটা ধমক দেখলুম— যেন বলছে, আঃ, আলোটা বন্ধ করো তো!

এবার দেখলুম, জিমির যে স্বভাব এতদিন চাপা ছিল, তার বশেই সে নিশুতি রাতে বেরিয়ে পড়েছিল। একটা কিলো দশেক ওজনের মহাশের মাছ মেরে খুদে শিকারিমশায় গর্বিত মুখে ফিরছেন।

জ্যাকিও লেজ নেড়ে খুব আনন্দ প্রকাশ করল। আমি জিমির পিঠে হাত

বুলোতে গিয়ে দেখলুম জল ঝরছে। বললুম, ‘ওরে, নিমুনি হবে যে! আয় মুছে দি।

তারপর ফায়ারপ্লেসে গিয়ে আগুন জ্বালি—সেঁকে নিবি।’ জিমি ড্যামকেয়ার-গোছের মাথা দোলাল। যেন বলল, আরে যাও যাও! রাতবিরেতে জলই তো আমাদের বড়ো আড্ডা। ওসব ভেবো না। বরং, গা মুছতে রাজি আছি। তার বেশি নয়।

তারপর থেকে ওকে নিশিরাতের অভিযানে যেতে আর বাধা দিতুম না। জানতুম বাধা দিলে ও মানবে না। শুধু ভয় হত সেই অজগর সাপটার কথা ভেবে। তার পাল্লায় পড়লে জিমি নিজেকে বাঁচাতে পারবে তো? অবশ্য এখন শীত। সাপটা নিশ্চয় গর্তে ঘুমোতে গেছে।

সারা শীতকালটা জিমি খুব মাছ শিকার করে খাওয়াল। বসন্তের এক রাতে সে

বারোটায় বেরিয়ে ফিরল একেবারে রাত তিনটেয়। উদবিগ্ন হয়ে দেখলুম, তার

নখে, ঠোঁটে, গায়ে চাপ চাপ রক্ত। শিউরে উঠে বললুম, ‘এ কী রে জিমি! কী হয়েছে?’ জ্যাকি খুব গর্জন শুরু করল। জিমিকে কোলে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখি, রক্ত জিমির নয়। অন্য কারও।

চমকে উঠলুম। এতদিন বসন্তে অজগরটার ঘুম ভেঙেছে নিশ্চয়। তাহলে কি জিমি তাকেই আক্রমণ করে বসেছিল? বললুম, ‘জিমি, জিমি! কার সঙ্গে লড়াই করে এলি তুই? এ কার রক্ত?? জিমির নীল চোখে আশ্চর্য হাসি ফুটে উঠল।

সেই রাতেই বন্দুক হাতে বেরিয়ে পড়লুম টর্চ নিয়ে। সঙ্গে চলল জ্যাকি আর জিমি। নদীর দহের কাছে গেলুম। টর্চের আলো ফেলতেই চমকে উঠলুম। হ্যাঁ, রাক্ষুসে অজগরটা রক্তাক্ত হয়ে মরে পড়ে আছে। এতদিনে জিমি তার মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *