StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

শিল্প ও স্থাপত্যের নিরিখে শাহজাহানের রাজত্বকালকে কী সুবর্ণ যুগ বলা যায়

 

শিল্প ও স্থাপত্যের নিরিখে শাহজাহানের রাজত্বকালকে কী সুবর্ণ যুগ বলা যায়?

অথবা,
শাহজাহানের রাজত্বকালে মুঘল স্থাপত্যের উপর আলোকপাত কর।

শাহজাহানের আমলকে ‘মুঘল স্থাপত্যের স্বর্ণযুগ’ বলে অভিহিত করা হয়। শাহজাহান স্থাপত্যশিল্পে মণি-মাণিক্য ব্যবহার করে মুঘল স্থাপত্যরীতিতে বিশেষ বৈশিষ্ট্য যুক্ত করেন। শাহজাহানের স্থাপত্যশিল্পে রঙের আতিশয্য ও আড়ম্বর লক্ষ্য করা যায়, যা বিদেশী স্থাপত্যশিল্পের আড়ম্বর ও অতি-অলঙ্করণকে স্বাগত জানায়। বলা হয়, শাহজাহানের স্থাপত্যগুলির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলা হয়েছে—’elegance rather than by strength and by the lavish use of extraordinary costly decoration’। শাহজাহান লাল বেলেপাথরের পরিবর্তে মূল্যবান শ্বেত পাথর ব্যবহার করে ভারতীয় ঐতিহ্য থেকে সরে আসেন। বলা হয়, শাহজাহানের আমলে নির্মিত সৌধগুলি সৌখিন কিন্তু দুর্বল।

শাহজাহানী স্থাপত্য-বৈশিষ্ট্যকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নারায়ণ সান্যাল লিখেছেন—‘মুঘল শিল্পরীতিতে তথা ইন্দো-ইসলামীয় স্থাপত্যে তিনি একটি নতুন স্টাইল আমদানি করলেন, যার বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য হল-মর্মরের ব্যাপক ব্যবহার, নয় পাঁপড়ি ওয়ালা খিলান, মণিমুক্তো খচিত Pietra dura নক্সার আধিক্য জাফরিকাজে নিপুণতা এবং আন্তর-বৈশিষ্ট্য হল আকবরী যুগের স্থাপত্য-পৌরুষ ও হিন্দুশৈলী সখ্যতা বর্জন। শাহজাহানের স্থাপত্য-সুখ্যাতির চার আনা অংশ আগ্রা কিল্লায়, চার আনা লাল কিল্লায়, চার আনা দিল্লীর জামি মসজিদসহ এখানে ওখানে ছড়ানো আর বাদ বাকি ষোলো আনা আগ্রার তাজমহলে। সোজা হিসাব।

শাহজাহানের স্থাপত্যশিল্পের উৎকৃষ্ট সৌধের নিদর্শনসমূহ আগ্রা, দিল্লী ও লাহোর দূর্গের ভিতরে ছড়িয়ে রয়েছে। এছাড়াও কাবুল, কাশ্মীর, কান্দাহার, আজমীর সর্বত্রই তিনি বহু অনুপম প্রাসাদ, মসজিদ ও উদ্যান নির্মাণ করেন।

১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহান দিল্লীর অদূরে ‘শাহজাহনাবাদ’ নামক এক নতুন রাজধানী শহর প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন এবং ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে এর প্রাসাদ-দূর্গের নির্মাণ কাজ শেষ হয়। তিনি আগ্রা থেকে রাজধানী ‘শাহজাহনাবাদ’-এ স্থানান্তরিত করেন। আগ্রা দূর্গের অনুকরণে এখানে তিনি ‘লালকেল্লা’ নামে একটি দূর্গ নির্মাণ করেন। এই দূর্গের ভিতরে তাঁর বাসস্থান, হারেম, দরবার নির্মিত হয়। লাল বেলেপাথরে তৈরি এই সুউচ্চ প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত প্রাসাদের বিশলতা বিশ্বের স্থপতিবিদদের বিস্মিত করে। এর দেওয়াল লাল বেলেপাথরে তৈরি হয়েছিল বলেই এটিকে ‘লালকেল্লা’ বলা হয়। দেওয়ালটির মোট দৈর্ঘ্য ২.৫ কিলোমিটার এবং উচ্চতা ১৮-৩০ মিটার। পার্সি ব্রাউন বলেছেন— এই স্থাপত্যে পারস্য ও রোমান রীতির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে”। সুপরিকল্পিত ও সমুন্বত এই প্রাসাদ দূর্গের প্রবেশপথ দু’টি—পশ্চিমদিকের মধ্যভাগে অবস্থিত প্রধান প্রবেশপথটি ‘লাহোর গেট’ এবং দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথটি ‘দিল্লী গেট’ নামে পরিচিত।

লালকেল্লার ভিতরে আগ্রা দূর্গের অনুকরণে ‘দেওয়ান-ই-খাস’ ও ‘দেওয়ান-ই-আম’ নির্মিত হয়েছিল। এই আড়ম্বরপূর্ণ হলঘর দু’টিতে বিশেষ অধিবেশন বা উৎসবের বিশেষ অধিবেশন বসত। ‘দেওয়ান-ই-খাস’-র থাম ও গম্বুজের অলঙ্করণ এবং পাথরের সঙ্গে সোনা ও রূপার ব্যবহার শাহজাহানের নতুন স্থাপত্যশৈলীরপরিচয় বহন করে। দেওয়ান-ই-আম’ দরবারটি দৈর্ঘ্যে ছিল ২০১ ফুট ও প্রস্থে ৬৭ ফুট। এটি নির্মাণে হিন্দু ও বৌদ্ধ শিল্পরীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ‘দেওয়ান-ই-আম’-এ থাম ও গম্বুজের আকার এমনভাবে  পরিকল্পিত হয় যে সিংহাসনে সম্রাট সামান্য জোরে কথা বললেও তা গোটা দরবার ও নিকটস্থ অঙ্গনে দাঁড়ানো লোকজন শুনতে পায়। হিন্দু স্থপতিবিদদের কলাকৌশলের চূড়াও প্রকাশ ঘটেছে এই ‘দেওয়ান-ই-আম’-এ। এর ঠিক মাঝখানে ছিল বিখ্যাত ‘ময়ূর সিংহাসন’। শিল্পী বেবাদল খাঁ এটি নির্মাণ করেন। রত্নখচিত ময়ূরবাহন হিসেবে সিংহাসনকে পিঠে করে রাখত।

‘মোতি মসজিদ’ (১৬৪৮-৬২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে নির্মিত) ‘দেওয়ান-ই-আম’-র উত্তরদিকে অবস্থিত। সরসীকুমার সরস্বতীর কথায়—its outstanding qualities illustrated Shah Jahan’s building style at its peak’। মসজিদটি আকৃতিতে ছোটো, লম্বায় ২৩৪ ফুট, চওড়াও ১৮৭ ফুট। ফার্গুসন এটিকে ‘one of the purest and most elegant buildings of its class to be found anywhere’—বলে বর্ণনা করেছেন।

“মুসাম্মান বার্জ” শ্বেতপাথরের নির্মিত একটি সুন্দর সৌধ। কেউ কেউ এটিকে জাহাঙ্গীর, আবার কেউ কেউ আকবরের আমলে নির্মিত বলে মনে করেন। আব্দুল হামিদ লাহোরির বর্ণনা থেকে জানা যায়, শাহজাহান এটিকে মার্বেল পাথরে রূপান্তরিত করেন মাত্র। এটি ছিল মমতাজ মহলের বাসস্থান। এখানেই ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

‘রঙ মহল’ বা ‘ইমতিয়াজ মহল’ শাহজাহানের সময় নির্মিত একটি দরবার হল। সমকালীন ঐতিহাসিকদের মতে—’স্বর্গের কল্পিত নন্দনকাননের থেকেও এটি সুন্দর’। এর ছাদের নীচে সোনার পাত ব্যবহার করা হয়েছিল। মেঝে ছিল শ্বেত-শুভ্র মার্বেল পাথরে মোড়া এবং চারদিক ছিল মণিমুক্তোয় শোভিত। এরই মধ্যে একটি ফোয়ারা নির্মাণ করা হয়েছিল। পার্সি ব্রাউন এটিকে ‘Crowning Jewel of Shah Jahan’s seraglio’ এবং ‘Stream of Paradise’ বলে অভিহিত করেছেন। রঙমহল ও মমতাজমহল লালকেল্লার এই প্রাসাদ দু’টি ছিল ‘জেনানা মহল’।

 সম্রাট নিজে থাকতেন ‘খাস মহল’-এ। এটি আকৃতিতে ছোটো হলেও চার ভাগে বিভক্ত ছিল। রঙমহলের মুখোমুখি দক্ষিণ দিকে ছিল একটি বারান্দা (বৈঠকখানা); এর ছাদে ছিল সুদৃশ্য নানা রঙের আলপনা, মধ্যভাগে ছিল তিনটি শোবার ঘর। পূর্বদিকে ছিল দূর্গ-প্রাচীর সংলগ্ন একটি বুর্জ, যেখান থেকে সম্রাট প্রতিদিন প্রজাদের দর্শন দিতেন। খাসমহল-র উত্তরে তিনটি ঘর নিয়ে ছিল সম্রাটের প্রার্থনা কক্ষ (‘তশিবখানা’)। খাসমহলের সামনে ছিল ২২০ ফুট লম্বা ও ১৬৯ ফুট চওড়া জমিতে ‘অঙ্গুরিবাগ’। 

চাঁদনিচকের দক্ষিণ দিকে শাহজাহান নির্মিত বিখ্যাত জামি মসজিদ অবস্থিত (১৬৫০-৫৬ সালের মধ্যে নির্মিত)। এটি ভারতের অন্যতম বৃহৎ মসজিদ। ৩০০ ফুট বিস্তৃত এই মসজিদ চত্বরে শুক্রবার সম্রাট সহ নগরের জনগণ সমবেত হতেন। গম্বুজ, মিনার ও অনেকগুলি দরজা দিয়ে এটি সজ্জিত। চাঁদনিচকের পশ্চিম প্রান্তে রয়েছে ফতেহপুরী মসজিদ।

শাহজাহানের রাজত্বকালকে সুবর্ণ যুগ বলা হয় কারন, শাহজাহান একই ধরনের বহু সৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। রাজত্বের প্রথম দিকে তিনি আগ্রা দূর্গে ‘দেওয়ান-ই-আম’ (১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ), ‘দেওয়ান-ই-খাস’ (১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ), ‘মোতি মসজিদ’ (১৬৫৪ খ্রিস্টাব্দ), ‘জামি মসজিদ’, ‘খাসমহল’, ‘নাগিনা মসজিদ’ নির্মাণ করেন। আগ্রা দূর্গের ‘দেওয়ান-ই-আম’লাল বেলেপাথরে তৈরি কিন্তু বাইরে মার্বেল পাথর দ্বারা শোভিত। অনেকে মনে করেন, শাহজাহান এতে মার্বেল প্লাস্টার ব্যবহার করেন মাত্র। শাহজাহানের আমলে আগ্রা দূর্গের প্রাসাদগুলি যেভাবে পুননির্মিত হয় সেভাবেই লাহোর দূর্গের প্রাসাদগুলিও পুনর্গঠিত হয়। এখানকার উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকীর্তি হল ‘দেওয়ান-ই-আম’, ‘শিসমহল’, ‘খোয়াব গড়’, ‘মুসম্মান বুর্জ’ ইত্যাদি। এগুলির মধ্যে পরে কয়েকটিতে আবার কিছু পরিবর্তন করা হয়। অর্থাৎ, শাহজাহানের রাজত্বকালকে সুবর্ণ যুগ বলা যুক্তিযুক্ত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *