টীকা লেখ – মথুরা শিল্প
শ্রীকৃষ্ণস্মৃতিবিজড়িত মথুরা নগরীর নাম ভারতের ইতিহাসে সুপরিচিত। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের মধ্যে এখানে বিকশিত শিল্পধারা ‘মথুরা শিল্প’ নামে পরিচিত। এই শিল্পধারার শিল্পীরা বুদ্ধজীবনের তাৎপর্য ও বুদ্ধচরিত্রের দৃঢ়তা এবং সংস্কৃতি ও মুক্তির পথপ্রদর্শক বুদ্ধদেবকে সঠিকভাবেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।
একথা সত্য, মথুরার প্রথম যুগের মূর্তি ও ভাস্কর্য শিল্পের নির্মাণশৈলীতে কিছুটা স্থূলতা ও কর্কশতা ছিল। উদাহরণস্বরূপ ‘বল’ নামে এক শ্রমণের উৎসর্গীকৃত (সারনাথে প্রাপ্ত) বোধিসত্ত্ব মূর্তিটির কথা বলা যায়। মূর্তিটি সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বড়। এটিকে দেখলে শুঙ্গ ও তার পরবর্তীকালের আদিম ভাবাপন্ন যক্ষ মূর্তিগুলির কথাই মনে হয়। সারনাথের যাদুঘরে রাখা দণ্ডায়মান বোধিসত্ত্ব মূর্তিটির উচ্চতা ছিল ১০ ফুট এবং এটি ৩ ফুট প্রশস্থ। মূর্তিটির বাম হাত কিছুটা কোমরে রাখা, দৃঢ় সংবদ্ধ পা দু’খানির উপর সরল সোজা দেহের ভার ন্যস্ত। এর ভাঙা ডান হাতটি সম্ভবত অভয় মুদ্রায় শোভিত। দৃঢ়তা ও পৌরুষের ভাবে মূর্তিটি সমুজ্জ্বল। মূর্তিটির দুপায়ের মাঝখানে একটি সিংহমূর্তি দেখা যায়।
উল্লেখ্য, সাহেত-মাহেতেও একটি বৃহৎ আকারের এবং প্রায় সারনাথেরই অনুরূপ মুর্তি দণ্ডায়মান অবস্থায় পাওয়া গেছে। কোশাম্বীতেও কনিষ্কের আমলে নির্মিত একটি বুদ্ধমূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে, তবে এটির দু’পায়ের মাঝখানে কোনো সিংহমূর্তি নেই।
মথুরার ‘কাটরা’ থেকে প্রাপ্ত সিংহাসনে উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তিটিতে পরবর্তীকালে বসা বুদ্ধমূর্তিগুলির আদর্শের সন্ধান পাওয়া যায়। এখানে শিল্পী বুদ্ধের মুখশ্রীতে একটি সুমার্জিত আত্মস্থ ভাব ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। বুদ্ধের পিছনে গোল প্রভা অথবা জ্যোতির্মন্ডলের দুদিকে দুটি গন্ধর্ব মূর্তি অগভীরভাবে খোদিত বোধিদ্রুম এবং তার দুপাশে ব্রহ্মা ও ইন্দ্র। এককথায় সমস্ত মহাপুরুষ লক্ষ্মণ এই মূর্তিতে প্রকাশ পেয়েছে এবং পরবর্তী ভারতীয় মূর্তিশিল্পের ইতিহাসে এই মূর্তিটি পরিকল্পনার ভাস্কর্য ধারারই বিকাশ ঘটেছিল।
কাটরা-উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তি অগভীরভাবে খোদিত বোধিদ্রুম এবং তার উপরোক্ত বোধিসত্ত্ব মূর্তিগুলি ছাড়াও সাধারণভাবে মথুরা ভাস্কর্যশিল্পের বোধিসত্ত্ব মূর্তির কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। মূর্তিগুলির অঙ্গ সৌষ্ঠবে পার্থিব শক্তির বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। প্রত্যেকটি মূর্তি দন্ডায়মান। সাধারণভাবে এগুলি গোলাকার, সামনাসামনি অবস্থিত। মূর্তিগুলির মস্তক মুন্ডিত ও গুম্ফহীন। এগুলির কপালে কোনো ওড়না নেই; উর্ধাঙ্গ অংশত আবৃত। ডান হাত অভয় মুদ্রায় উত্থান ভঙ্গিতে ধরা এবং বামহাত উরুর উপর রাখা থাকে। বক্ষ সামনের দিকে প্রলম্বিত, স্কন্ধ প্রশস্ত যা শক্তির ইঙ্গিত দেয়, অথচ উন্মীলিত চক্ষুদ্বয় এবং মৃদু হাস্যময় মুখমন্ডলে ভক্তিরসের প্রাধান্য বর্তমান। মথুরা শিল্পের এইধরনের বৃহদায়তন মূর্তিগুলি নির্ভেজাল ভারতীয় ভাস্কর্যের নিদর্শন ও প্রাণবন্ত শিল্পকলার জীবনস্রোত।
গান্ধার ভাস্কর্যে বুদ্ধমূর্তি নির্মাণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করলেও একমাত্র উপজীব্য ছিল না। জৈনধর্মের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মহাবীর ছাড়াও ঋষভ সম্ভবনাথ, নন্দীবিসলের মূর্তিতে। এই মূর্তিগুলির কয়েকটি আবার চারটি মুখবিশিষ্ট। আকার আয়তনের দিক থেকে এগুলি বুদ্ধমুর্তিগুলির মত। এছাড়াও মথুরার জৈন মন্দিরে ‘অর্হৎ’-দের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত‘আয়গ-পত্ত’বা নিবেদন ফলকগুলিতে ভারতীয় রীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
মথুরার শিল্পে ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়ও স্থান পেয়েছিল। কুষাণ যুগে মথুরা শিল্পীদের রচিত নারীমূর্তি নির্মাণ ও তার রূপকল্পনাকে তুলে ধরা হয়েছিল যক্ষিণী মূর্তিগুলির মধ্যে দিয়ে। এইরূপ একটি মূর্তিতে স্তম্ভের গায়ে খোদিত নারীমূর্তি—ডানহাতে কাপড়ের কোচা এবং বামহাতে একটি লতা ধরে সুন্দর ভঙ্গীতে গাছের গায়ে দাড়িয়ে থাকে। দেহের গঠন লাবণ্যপূর্ণ।
দ্বিতীয় একটি মূর্তি বাম হাত কোমরে রেখে ও ডানহাতে একটি পাখির খাঁচা নিয়ে দাড়িয়ে আছে। মূর্তির সূক্ষ্ম বস্ত্রখানি রচনার শিল্পনৈপুণ্য চমৎকৃত করে। মূর্তিগুলির রূপকল্পনায় একদিকে যেমন লাবণ্য ও নমনীয়তা স্থান পেয়েছে তেমনি কামনার আবেদনও বিরাজমান। মথুরার একটি স্তম্ভের গায়ে একটি বালক মূর্তি খোদিত আছে। অনেকে এটিকে বৃক্ষ দেবতার মূর্তি বলে মনে করেন। পাগড়ি মাথায় অলঙ্কার পরা বালক মূর্তিটিতে একটি স্নিগ্ধ ও পরিচ্ছন্নভাব ফুটে উঠেছে। এই মূর্তিগুলির দেহভঙ্গী সবই ভারতীয় শিল্পশাস্ত্রের আদর্শ অনুসারে রচিত এবং বৈদেশিক প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। এগুলি মথুরা শৈলীর শেষ পর্বের কাজ।
সমৃদ্ধ মথুরা নগরীতে রাজপুরুষদের ভাস্কর্যগুলিও বিশেষ উল্লেখ রাখে। এর মধ্যে কুষাণ যুগের প্রথমভাগে নির্মিত কনিষ্কের মস্তকহীন মূর্তিটি প্রধান। মথুরা থেকে ৯ মাইল দূরে এই মূর্তিটি পাওয়া গেছে। মূর্তিটি দন্ডায়মান, একটি বেদীর উপর বীরত্বপূর্ণ অবস্থায় উপস্থাপিত। মূর্তির গায়ে লম্বা অঙ্গ রাখা, ভারী পায়ের উপর বুট জুতো, রাজদন্ড সোজা কৃপানে সজ্জিত।
কনিষ্ক মূর্তির সর্বাঙ্গীন পোষাক পরিচ্ছদ এবং সম্মুখ ভাগের খোদিত লিপি থেকে অনুমিত হয়, মূর্তিটির ভাস্কর ছিলেন স্কাইথিািয় বা শক। চস্টনের মূর্তিটিও ভারী বুট পরিহিত এবং তার হাতে একটি তরবারি রয়েছে। এইসমস্ত মূর্তিগুলিতে মথুরা শিল্পে মধ্য-এশীয় বা শকদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিম কদফিসের মূর্তিটি সিংহাসনের উপর উপবিষ্ট, দুপাশে দুটি সিংহ। এখানেও বিম কদফিসেসকে বুট জুতো পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। এর মাথায় গোল সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত শিরস্ত্রান, ডান হাতে রাজদন্ড ও বামহাতে ছোট কৃপান। মথুরা ছাড়াও আফগানিস্থানে সুরকোটালে এধরনের অনেক মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে।
মূর্তিগুলির সাজসজ্জা ও অলঙ্কার ইত্যাদিতে পারস্য দেশীয় প্রভাব বর্তমান। তবে মথুরার শিল্পীরা কোনো বিশেষ বৈদেশিক লক্ষ্মণ গ্রহণ করেননি। রাজার মূর্তিতে শক্তিমত্তা, বীরত্ব, কাঠিন্যের ভাব বজায় রাখলেও; লালিত্য ও কমণীয়তার অভাব থাকলেও সূক্ষ্ম কারুকাজ ও অলঙ্করণে কোনো মথুরা শিল্পী অবহেলা দেখাননি। মথুরায় একটি সিংহের সঙ্গে বীরপুরুষের যুদ্ধের চিত্রটিকে অনেকে গ্রিক পুরাণের হারকিউলিসের সিংহ বধের মূর্তি বলে মনে করেন। কিন্তু মথুরা শিল্পের প্রধান ভাবধারা ভারতীয় ভাবনা দ্বারা পুষ্ট ছিল। রোমান প্রভাব মথুরা শিল্পকে কিছুটা স্পর্শ করলেও এর মৌলিক চরিত্রকে পরিবর্তন করতে পারে নি।
মথুরা শিল্পের মধ্যে ভারতীয় শিল্প ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা প্রতিফলিত হয় খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর মথুরা সংলগ্ন এলাকার বেশ কিছু স্তম্ভ ও স্তম্ভের নিম্নাংশে উৎকীর্ণ ভাস্কৰ্যসমূহ থেকে। এই ভাস্কর্য নিদর্শনগুলির সঙ্গে শুঙ্গ-কুষাণ যুগের পোড়ামাটির নিদর্শনগুলির যেমন ঘনিষ্ঠ যোগ আছে, তেমনি ভারহৃত, বুদ্ধ-গয়া ও সাঁচীর ভাস্কর্যের ধারাবাহিকতা রয়েছে। ভারতীয় শিল্পের ক্ষেত্রে মথুরায় তৈরি ভাস্কর্যগুলি অতি সহজেই চেনা যায়। মথুরা ও তার নিকটবর্তী স্থানের লাল পাথর খোদাই করেই এই মূর্তিগুলি তৈরি হত এবং এই বিশেষ ধরনের লাল পাথরের গায়ে থাকত সাদা ও হলদে রঙের দাগ।