সুলতানি আমলে বাংলার স্থাপত্য সম্পর্কে একটি ধারণা দাও।
বাংলায় পাথর সহজলভ্য না হওয়ায় বাংলার স্থাপত্যে পাথরের পরিবর্তে ইঁটের ব্যবহার বেশি লক্ষ্য করা যায়। এগুলির বাইরে পাথর এবং ভিতরে ইট দিয়ে যে ইট-পাথর রীতির প্রচলন হয়, বাংলায় প্রাক্-সুলতানী যুগে তা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। বাংলার গৌড় ও পাড়ুয়ার স্থাপত্যকীর্তিগুলির সিংহভাগই ইঁট এবং চুন ও সুড়কির নির্মিত। বাংলায় ইতিপূর্বে চুন মেঝেতে ব্যবহার করা হত। মুসলিমরা বাংলায় চুনকে জোড়া লাগাবার পদ্ধতির প্রবর্তন করে।
মুসলিম আমলের গোড়ায় চুনকে খিলান, কার্নিশ ও ছাদে ব্যবহার করা শুরু হয়। বাংলা স্থাপত্যের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল থামের উপর চালার আকারে খিলান। বাংলায় খড়ের চালের আকারে খিলানগুলি নির্মিত হত। মূলত রাজধানীগুলিকে সজ্জিত করার প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়েই বাংলায় নানাধরনের সৌধ নির্মিত হয়। বেশিরভাগ সৌধই চতুষ্কোণ ভিত্তির উপর ইঁট বা পোড়ামাটির টালি দিয়ে নির্মিত। বহুক্ষেত্রে রঙিন ও এনামেল করা টালির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। সম্ভবত, সুলতানি রাজত্বে চীন থেকে এই কৃৎকৌশল বাংলায় প্রবেশ করেছিল।
বাংলার প্রাচীনতম মুসলিম স্থাপত্য হুগলী জেলার ত্রিবেনিতে (সপ্তগ্রাম) জাফর খান গাজীর সমাধি (১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ)। এর সাথে একটি মসজিদও রয়েছে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, এটি আগে হিন্দুদের সৌধ ছিল। এখানে প্রায় শুকনো নদীর পাশে দু’টি ছাদখোলা চতুষ্কোণ গৃহ রয়েছে। এটিকেই সমাধি রূপে ব্যবহার করা হত।
দীর্ঘকাল বাংলা স্বাধীন থাকায় গৌড় ও পান্ডুয়াকে কেন্দ্র করে একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিল। গৌড়ের বড়সোনা মসজিদ (১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ) সুলতানি আমলে নির্মিত বাংলার এক অনবদ্য স্থাপত্য। এই মসজিদটি বিশালা এলাকায় বিস্তৃত একাধিক একই উচ্চতার নীচু গম্বুজযুক্ত, সামনে একটি উন্মুক্ত প্রাঙ্গন রয়েছে। গৌড়ের ‘ছোটোসোনা মসজিদ’-টিরও গঠনরীতি অনুরূপ। দু’টি মসজিদেই প্রাচীরের বাইরের গায়ে চকচকে টালি ও রঙ দ্বারা রঞ্জিত করা হয়। এর থেকেই সম্ভবত ‘সোনা’ শব্দটির ব্যবহার হয়েছিল।
গৌড়ের অন্যতম কাঠামোটি ছিল ‘ফিরোজ মিনার’ (১৪৯০ খ্রিস্টাব্দ)। ইটের তৈরি এই মিনারটি উত্তর ভারতে নির্মিত মিনারগুলির মত গোলাকার নয়। শিল্প বিশেষজ্ঞরা এই মিনারটির স্থাপত্যরীতিতে আইরিশ স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব লক্ষ্য করলেও ভৌগোলিক কারণে এই সংযোগ সম্ভব ছিল না। এছাড়াও গৌড়ের অন্যান্য স্থাপত্য নিদর্শনগুলি হল ‘লোটোন মসজিদ’, বাগেরহাটের ‘শাট গম্বুজ’, ‘কদম রসুল’ ও ‘দাখিল দরওয়াজা’।
পাণ্ডুয়ায় সিকান্দর শাহ নির্মিত আদিনা মসজিদটি ভারতের অন্যতম বৃহৎ মসজিদ (১৩৬০ খ্রিস্টাব্দ)। এই মসজিদটি নির্মাণে হিন্দু মন্দিরের অংশ ব্যবহারে ছাপ স্পষ্ট। এই মসজিদে অসংখ্য তোরণ ও চার শো স্তম্ভ, বহু সুদৃশ্য খিলান ও ৩৭৮টি গম্বুজ ছিল। মসজিদটির আয়তন ৩৯৭ ফুট x ১৫৯ ফুট। একটি বিশাল প্রাঙ্গনকে ঘিরে মসজিদটির কাঠামো নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরের প্রার্থনা স্থলটি একটি ফোরাম (Forum)-র মত পশ্চিমে প্রাচীরের গায়ে পাঁচটি এবং পূর্বদিকে তিনটি যাতায়াতের পথ রয়েছে।
আদিনা মসজিদটির নির্মাণে স্যারাসেনীয় প্রভাব স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। মসজিদটির একটি অংশ অপর অংশ থেকে কিছুটা উঁচুতে। এটি সারিযুক্ত স্তম্ভের উপর কালো পাটাতন বিছিয়ে নির্মাণ করা হয়। সম্ভবত সুলতান ও তার পরিবার এখানে একটি পৃথক প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রার্থনার উদ্দেশ্যে উপস্থিত হতেন। এটিকে এই কারণে ‘বাদশাহ কা তখ্ত’ বলা হত।
পান্ডুয়ার ‘একলাখি মসজিদ’-টি ৮০ বর্গফুট এলাকা বিশিষ্ট একটি কাঠামো। এর শীর্ষে চুন ও সুড়কি দ্বারা নির্মিত একটি বিশাল গম্বুজ রয়েছে। সম্ভবত, এই মসজিদটি নির্মাণে এক লক্ষ মুদ্রা ব্যয় হওয়ায় এটির এইরূপ নামকরণ করা হয়। পান্ডুয়ার অন্য একটি কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এটিকে বলা হয় ‘হাম্মাম’। প্রাসাদ এলাকার মধ্যে নির্মিত এই কাঠামোটি একাধিকল তলবিশিষ্ট, ইঁট দ্বারা গঠিত। ঘরের মেঝে পাথর দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল বলে মনে হয়। পাশের একটি জলাশয় থেকে বলদ বা ঘোড়ার সাহায্যে জল উপরে তোলা হত এবং পোড়ামাটির নালার মাধ্যমে তা বিভিন্ন স্নানঘরে পৌঁছে দেওয়া হত। এই ‘হাম্মাম’ সমগ্র ভারতে দিল্লী ছাড়া আর কোথাও ছিল না এবং শুধুমাত্র এই কারণেই সুলতান ফিরোজ তুঘলক বাংলা আক্রমণ করেন বলে লোকমুখে প্রবাদ প্রচলিত আছে।