StudyMamu

Site is under construction some pages not work properly. Please bear with us.

প্রাচীন ভারতে ইন্দো রোম বাণিজ্য । ভারত রোম বাণিজ্য

প্রাচীন ভারতে ইন্দো রোম বাণিজ্য 

অথবা,

ভারত রোম সমুদ্র বাণিজ্য

অথবা,

ভারত রোম বাণিজ্যের প্রকৃতি

অথবা,


মৌর্য-পরবর্তী যুগে ভারত-রোম বাণিজ্যের বিবরণ দাও।

অথবা,

ভারত রোম বাণিজ্যের সম্পর্ক

আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব 200 থেকে 300 খ্রিস্টাব্দ 5 শতাব্দি উপমহাদেশের বাণিজ্যের ইতিহাসে এক অতিউজ্বল অধ্যায়। উপমহাদেশের অভ্যন্তরে ও বাহিরে বাণিজ্যিক ক্রিয়া-কলাপ এর ব্যাপক তা পূর্ববর্তী যুগের দেখা যায় না। বৌদ্ধ সাহিত্য ও জাতকের উল্লেখ থেকে সফল ব্যবসায়ী হিসেবে সেটঠির ভূমিকা উদঘাটন করেছেন রিচার্ড ফিক ও অতীন্দ্রনাথ বসু। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা হিসেবে শ্রেষ্ঠী সার্থবাহ ও সাধারণ বণিকের উজ্জ্বল ও সক্রিয় ভূমিকা প্রতিভাত হয়েছে অজস্র দান লেখতে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে এযুগের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ হল দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে রোমান সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধ বাণিজ্য।

রোমের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কে উত্তর-পশ্চিম ভারতের কুষানগন ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য অংশগ্রহণ করেছিল। কুষাণদের ক্ষেত্রে এই বাণিজ্য ছিল স্থল এবং জলপথে। দক্ষিণী রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে প্রধানত জলপথে। তাদের সাহিত্য ব্যাপক সামুদ্রিক কার্যকলাপ এর পরিচয় বহন করে। যেখানে পোতাশ্রয়, ডক, বাতিঘর শুল্ক দপ্তর ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায় ‌। এই বাণিজ্যে ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চলের স্থান ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই অঞ্চলের মধ্যমনী মিশর ছিল তৎকালীন রোমের শাসনাধীন এবং মিসরের সঙ্গে ভারতের একটি নিকট সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

পশ্চিম এশিয়ার পাথিয় রাজ্য প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতের সঙ্গে পাশ্চাত্যের গ্রিকদের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সংযোগ স্থাপন সম্ভব ছিল না। পরবর্তী সাসানীয় সাম্রাজ্য দীর্ঘকাল ভারতকে পশ্চিমের রাজ্যসমূহ এবং রোম সাম্রাজ্য থেকে আড়াল করে রেখেছিল। ব্যাকট্রিয়ায় শক আক্রমণ এবং সিরিয়ার অরাজকতা একদিকে স্থলপথ এর সুযোগ সুবিধা সংকুচিত করে সমুদ্র পথ এর গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করেছিল । তবে খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দী পূর্বে ভারতের সঙ্গে মিশরের বাণিজ্য প্রত্যক্ষভাবে না হয়ে পরোক্ষ ভাবে পরিচালিত হতো। ভারতীয় ও পাশ্চাত্য বণিকরা অধঃপথে সম্ভবত এডেন বন্দরে মিলিত হয়ে পরস্পর পণ্য বিনিময় করত। খুব সম্ভব আরব বণিকরা এই আদান-প্রদানের মধ্যস্থতা করত , পেরিপ্লাসে এর উল্লেখ পাওয়া যায়।

ভারতের সঙ্গে রোমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক লেনদেন খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে শুরু হয়ে 400 বছরের বেশি স্থায়ী হয়েছিল। খ্রিস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকের সম্রাটগণ সাঁথিয়ার মধ্য দিয়ে স্থল পথ পরিহার করে ভারতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সামুদ্রিক বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। সম্রাট অগাস্টাস খ্রিস্টপূর্ব 25 অব্দে ভারত যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় সমুদ্রপথের অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে একটি অভিযান পাঠিয়েছিলেন। ভারত সম্পর্কে পাশ্চাত্যের আগ্রহ সাহিত্যকোষ শিল্পেও প্রতিফলিত হয়েছিল। পম্পি নগরীর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে হাতির দাঁতের তৈরি একটি ক্ষুদ্র মূর্তি পাওয়া গেছে। রোম সম্পর্কে ভারতের আগ্রহ ও কিছু কম ছিল না । খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দি থেকে শুরু করে চতুর্থ শতাব্দীতে ভারত বিভিন্ন রোমান সম্রাটের কাছে রাষ্ট্রদূত পাঠিয়েছিল। স্ট্যাবোর রচনা থেকে জানা যায় যে, দক্ষিণ ভারতের জৈনক পান্ডরাজা রোম সম্রাট অগাস্টাসের কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন।

স্থলপথ এবং সমুদ্রপথে ভারতের সঙ্গে পাশ্চাত্য জগতের বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি ঐতিহাসিক ঘটনা কাজ করেছিল। রোম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় রাজনৈতিক শান্তি ও যোগাযোগ সহজ হয়েছিল। বাণিজ্য পথের নিরাপত্তা বেড়েছিল এবং লোমে ভারতীয় বিলাস সামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিল। এছাড়াও আরও কয়েকটি কারণ ছিল।

প্রথমত :

কুষাণদের রাজ্যজয় এই বাণিজ্য কে সাহায্য করেছিল। ফলে রোম ভারত বাণিজ্য এর জন্য স্থলপথ উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। 

দ্বিতীয়তঃ ব্যাকট্রিয়া , কাবুল উপত্যাকা পাঞ্জাব যমুনা উপত্যাকা এবং উত্তর গাঙ্গেয় উপত্যকায় ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রশক্তির অবস্থান গঙ্গা এবং ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যে নিয়মিত বাণিজ্য সম্ভব হয়েছিল।

তৃতীয়তঃ

দীর্ঘ সংঘর্ষের পর খ্রিস্টীয় 63 অব্দে উভয়ের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় অধ শতাব্দীকাল স্থায়ী এই চুক্তি বাণিজ্যের সহায়ক হয়েছিল।

 চতুর্থত :

খ্রিস্টীয় 47 অব্দে হিপ্পলাস নামক ভারত মহাসাগরে মৌসুমী বায়ুর আবিষ্কার এবং ভারতের পশ্চিম উপকূলে ভৃগুকচ্ছের উপর কুষাণদের অধিকার এই বাণিজ্যে বেগ সঞ্চার করেছিল। একাধিক জলদস্যু আক্রমণের আশঙ্কা যেমন কমে ছিল তেমনই তিন মাসেরও কম সময়ে ভারতীয় পণ্য আলেকজান্দ্রিয়ার বন্দরে পৌঁছায় এবং ভারতে আসা জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল।

স্থলপথের বাণিজ্যে :

ভারতের সঙ্গে রোম সাম্রাজ্যের স্থলপথে বাণিজ্যের পরিমাণ ও নেহাত কম ছিল না। উপমহাদেশে বাণিজ্যের বিকাশে বিশেষ সহায়ক ছিল কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থলপথ। পশ্চিম উপকূলের প্রসিদ্ধি বন্দর ভৃগুকচ্ছর সঙ্গে কাবুল অঞ্চল স্থলপথ যুক্ত ছিল। পেরিপ্লাস অনুযায়ী কাবুল থেকে পুষ্কলাবতী ও তক্ষশীলা হয়ে পাঞ্জাব ও গঙ্গা-যমুনা ডাবের মধুরা নগরী ছুঁয়ে বাণিজ্য পথটি আসতো পশ্চিম মালষবের উজ্জয়নী পর্যন্ত। উজ্জয়নী থেকে আরেকটি স্থলপথ প্রসারিত ছিল কারুগাজা পর্যন্ত। এই বাণিজ্যের চীনের রেশম ছিল বিলাসী উপকরণের মধ্যে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পণ্য। রেশম কেবলমাত্র চীনের উৎপন্ন হতো এবং অতি দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ভুমধ্যসাগরের পূর্ব সীমায় পৌঁছত। অতি দুর্গম ও ভয়াবহ টাকলামাকান মরুভূমিকে এড়িয়ে দুন হুয়া উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি পথ বিভক্ত হয়েছিল। চীনের রেশমি যেহেতু একটি স্থল বাণিজ্যের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ পণ্য তাই তা উনবিংশ শতাব্দী থেকে রেশম পথ অভিদায় চিহ্নিত হতে থাকে। রোমের সঙ্গে পাথিয়ার সম্পর্ক বেশিরভাগ সময় তিক্ত থাকায় চীনের পণ্য সরাসরি পশ্চিমে যেতে পারত না। তক্ষশীলা এবং ভৃগুকচ্ছ হয়ে যেত কুষাণদের অধীনে এ কারণেই উত্তর-পশ্চিম ভারতের আর্থিক সমৃদ্ধির বৃদ্ধি পেয়েছিল।

সামুদ্রিক বাণিজ্য :

 রোমের সঙ্গে সামুদ্রিক বাণিজ্য দক্ষিণ ভারত অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। এই বাণিজ্য ছিল সবচেয়ে লাভজনক এবং রোমের পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক। পশ্চিম এশিয়া এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে আগত যবন বণিকরা সাতবাহন রাজ্যে এবং শুধু দক্ষিণের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যে বসতি স্থাপন করেছিল। এই প্রসঙ্গে পন্ডিচেরির নিকটবর্তী আরিকামেডু মাদুরাই এবং মুসিরিস এর নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আরিকামেডুতে রোমের মুদ্রা কাচের জিনিস পাওয়া গেছে। তা শুধু বাণিজ্যকেন্দ্র ছিলনা রোমান রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী মসলিনও এখানে তৈরি হত। প্রাপ্ত রোমান দ্রব্যাদি থেকে অনুমান করা হয় যে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দি থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের প্রজন্ত রোমানরা এই বন্দর ব্যবহার করেছিল। মাদুরাই তে অসংখ্য তাম্রমুদ্রা পাওয়া গেছে। বহু আকস্মিক চিনের রেশম রেশম জাতীয় পদার্থ ব্যাকট্রিয়া ও কাবুল হয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পেরিয়ে পৌছাত হয় সিন্ধু বা দীপ এলাকার অথবা তক্ষশীলা থেকে মথুরা ও উজ্জয়িনী হয়ে তা আসত গুজরাট উপকূলে। সেখান থেকে সমুদ্রপথে তা পৌছোত লোহিত সাগরের এলাকায় এবং শেষ পর্যন্ত রোমে । 

রপ্তানিকৃত পণ্যে-সামগ্ৰি :

 পেরিপ্লাসে রোম ভারত বাণিজ্যের আমদানি-রপ্তানির বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। রপ্তানিকৃত ভারতীয় পণ্যের মধ্যে ছিল দামি ও সূক্ষ্ম মসলিন সহ বহু সম্ভাব গজদন্ত। দুর্মূল্য রাত্রের মধ্যে ভারতের হীরা বৈদুর্য এবং মুক্তোর প্রসিদ্ধ রোম সাম্রাজ্যের পৌঁছেছিল। রপ্তানিযোগ্য বিলাস সামগ্রীর মধ্যে অবশ্যই তালিকাভুক্ত ছিল বিবিধ মসলা, যার মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য মালাবারের গোলমরিচ বিদেশের কাজের অগ্নি মূল্যে বিক্রি হতো।

অন্যদিকে ভারতে আমদানি করা পণ্যের মধ্যে অবশ্যই ছিল চীনের রেশম যার একাংশ ভারতের মধ্য দিয়ে আবার সমুদ্রপথে রপ্তানি হয়ে যেত। বিভিন্ন প্রকার সূরা ও কাচের সামগ্রী ভারতে আনা হতো। এই সূরা ও ইতালির বিখ্যাত অলিভ অয়েল অনাহত অ্যাম্ফোরা জাতীয় আঁধারে। রোম ভারত বাণিজ্য এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে অ্যাম্ফোরার বিশিষ্ট মর্যাদা আছে। একইসঙ্গে ইতালির অ্যারেজো অঞ্চলে প্রস্তুত রক্তিম চকচকে মৃৎপাত্র ।অ্যারেটাইন পটারি আসত ভারতে। রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যের ভারতে নিয়মিত ভাবে আনা হতো রোমক মুদ্রা। রোমক মুদ্রা ভান্ডারে অবশ্যই সর্বাধিক আবিষ্কৃত হয়েছে দক্ষিণ ভারতের। বলাবাহুল্য এই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ভারত থেকে রপ্তানিকৃত পণ্যের পরিমাণ বেশি থাকায় ভারতবর্ষ সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। অতিশয়োক্তি থাকলেও প্লিনির বক্তব্য উল্লেখ যে, ধনী রোমানদের বিলাসদ্রব্যের আকাঙ্ক্ষা মেটাতে রোম থেকে সোনার নির্গমন ঘটেছে।

ভারত রোম বাণিজ্যের প্রভাব:

ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনীতিতে ইন্দো-রোম বাণিজ্যের প্রভাব দক্ষিণ ভারতের উপর বেশি পড়েছিল। কিন্তু গ্রিক-রোমান ভাবধারার প্রভাব পড়েছিল উত্তর ভারতে। সংস্কৃত শব্দ গ্রিক এবং লাতিন শব্দ ভান্ডারে গৃহীত হয়েছিল। গ্রিক শব্দ আবারঃ সংস্কৃতি অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল। ভারতীয় মুদ্রার গ্রহ নক্ষত্র বিজ্ঞানে, বৌদ্ধধর্ম শিল্পের বিবর্তনে এই প্রভাব অত্যন্ত স্পষ্ট এবং গান্ধার শিল্প এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভারতের সঙ্গে এই বাণিজ্যিক সংযোগের অন্যতম স্থায়ী ফল হল স্ট্রাবো,এরিয়ান ,প্লিনি,টলেমি, প্রমুখের রচনায় এবং পেরিপ্লাস গ্রন্থে ভারতের বিস্তৃত বিবরণ। ভারতের মতো পাশ্চাত্য ও এই বাণিজ্যিক যোগাযোগ এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি পশ্চিম এশিয়ায় বিশেষ মর্যাদা পেয়েছিল। ভারতীয় সাংখ্য দর্শন এবং পিথাগোরাসের দর্শনের মধ্যে মিল ছিল অত্যশ্চয । 

ভারত রোম বাণিজ্যের অবসান:

 তবে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে রোমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য অবনতি দেখা দেয় এবং পরবর্তীকালে যখন বর্বর জাতির আক্রমণের ফলে রোম বিপন্ন তখন এই বাণিজ্যের অবসান ঘটে। ঐতিহাসিক ব্যাসাম লিখেছেন, গুপ্ত যুগের আগে সমুদ্রপথে চিত্রের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের সংযোগ স্থাপিত হয় এবং পাশ্চাত্যের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ায় চীনের সঙ্গে তা বৃদ্ধি পায়। ভারতের মশলার সুগন্ধি দ্রব্য মণিমুক্তো এবং অন্যান্য বিলাস দ্রব্য জন্য চীনের চাহিদা এই বাণিজ্যে ইন্ধন যোগায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *