ইতিহাস কি বিজ্ঞান? আলোচনা কর।
ইতিহাস কি সত্যিই বিজ্ঞান পদবাচ্য হতে পারে, অনেকেই ইতিহাসকে বিজ্ঞান বলে মনে করেন কারণ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ঘটনার বাস্তব ব্যাখ্যা ও মৌল সত্য উদ্ঘাটন করাই ইতিহাসের ধর্ম। ইতিহাস শব্দটির উদ্ভব গ্রীক শব্দ ইস্তোরিয়া বা ‘istoria’ থেকে যার অর্থ অনুসন্ধান, অন্বেষণ ও তথ্য। অন্যদিকে বিজ্ঞান বা ‘Science’ কথাটি এসেছে লাতিন শব্দ ‘Scientia’ থেকে যার অর্থ হল “sytematic and fundamental knowledge” অর্থাৎ সুসংবদ্ধ মৌলিক জ্ঞান।
ফরাসী ইতিহাসদার্শনিক তথা গণিতজ্ঞ অগস্ট কোমতে বলেন যে, বিজ্ঞানচর্চায় বীজগণিতের সূত্র দিয়ে যেমন একটি অর্ধবৃত্তকে পরিমাপ করা যায়, তেমনই সাধারণ নিয়মকে অনুসন্ধান করে ইতিহাসচর্চর মধ্যে দিয়ে মানবসভ্যতার চলন বা ধারাটিকেও অনুধাবন করা যায়। কোমতে ইতিহাসকে বিজ্ঞানচর্চার বস্তুতান্ত্রিক লক্ষণযুক্ত একটি “ positive philosophy” বা সদর্থক দর্শন ( ইতিহাস দর্শন ) বলে চিহ্নিত করেন।
তথ্যকে নৈর্ব্যাক্তিক দৃষ্টিতে বা নিরপেক্ষ ভঙ্গিতে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করার মধ্যে দিয়ে একজন ঐতিহাসিক তার ইতিহাসচর্চাকে বিজ্ঞানচর্চার মতোই অভ্রান্ততা প্রদানের চেষ্টা করতে পারেন। অধ্যাপক টেগার্ট যথার্থই বলেছেন যে ঘটনার অভ্যন্তরীণ গতিধারার সুশৃঙ্খল অন্বেষণই হল বিজ্ঞান এবং এই অর্থে ইতিহাসকে নিশ্চয় বিজ্ঞান বলা চলে।
![]() |
ইতিহাস ও বিজ্ঞান |
মার্কিনী কুটনৈতিক ইতিহাসচর্চার সঙ্গে জড়িত প্রখ্যাত গবেষক Bernadotte Achmitt বলেছেন যে, যদি সকল প্রকার সংস্কার ও মানসিক ঝোক মুক্ত হয়ে একজন ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত সকল তথ্যকে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে কেবল সত্যানুসন্ধানের জন্যই অতীতের অন্বেষণ করেন তাহলে ইতিহাসচর্চা আর বিজ্ঞানচর্চা সমার্থক হয়ে যায়। তিনি অভিমত প্রকাশ করেছেন যে আধুনিক যুগে ঐতিহাসিকগণ যেভাবে তথ্যকে যাচাই ও বিশ্লেষণ করে থাকেন তা নিশ্চিতভাবেই পরীক্ষাগারে সাধিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মতোই।
আধুনিক কালের ইতিহাসচর্চায় ঐতিহাসিকগণ যে পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকেন তার মধ্যে বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলা সম্পূর্ণ মাত্রায় বর্তমান। নেইবুর এবং র্যাঙ্কে তাদের ইতিহাসের তথ্যকে আণুবিক্ষণিক বিশ্লেষণাত্মক মনোভাব নিয়ে বিচার করেছেন ট্র্যাভেলিয়নও মন্তব্য করেছেন যে ইতিহাসের মধ্যে সত্য উপস্থাপিত হলে তাকে নিশ্চিতভাবেই বিজ্ঞান বলা চলে।
নৃতত্ত্ববিদ E E Evans Pritchard লিখেছেন যে একজন নিরপেক্ষ ও সচেতন ঐতিহাসিক একজন রসায়নবিদ বা একজন জীববিজ্ঞানীর মতো করেই তার গবেষণা ও তথ্য বিশ্লেষণ করেন পদ্ধতিগতভাবে উভয়ের কাজে কোনো তারতম্য না থাকলেও পার্থক্য রয়েছে যে বিষয় বা ঘটনা নিয়ে তাঁরা গবেষণা করছেন তার প্রকৃতি বা চরিত্রে। বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয় প্রকৃতি ও বস্তুজগত যেখানে একটি ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া স্থান-কাল-ব্যক্তি নির্বিশেষে এক, কিন্তু ইতিহাসের গবেষণার বিষয় মানুষ বা মানবসমাজ – ব্যক্তি বা সমাজবদ্ধ মানুষের ক্ষেত্রে একই ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া অভিন্ন নয়, ভিন্ন হতে পারে। এর ফলে ইতিহাসবিদকে ঘটনার সাধারণ নিয়ম এবং তার বাতিক্রমী অভিনবত্ব বা স্বাতন্ত্র্য উভয় নিয়েই কাজ করতে হয়। এইখানেই বিজ্ঞান ও ইতিহাস – উভয় প্রকার চর্চার প্রভেদগুলি প্রাসঙ্গিক ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ইতিহাসকে বিজ্ঞান বলে মানতে চাননি এরূপ পন্ডিতের সংখ্যাও স্বাভাবিক ভাবেই কম নয় এবং এই পণ্ডিতগণো নিজ নিজ যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে ইতিহাসচর্চার পদ্ধতি এবং বিজ্ঞানচর্চার পদ্ধতি অনেকাংশেই আলাদা। যেমন, ফ্রাউদে (Froude) মনে করেন যে ইতিহাস যেহেতু মানবগোষ্ঠী বা মানুষের আচরণ নিয়ে আলোচনা করে এবং যেহেতু মানুষের বৈচিত্রপূর্ণ আচরণকে অনুমান করা সম্ভব নয়, সেহেতু ইতিহাসে বিজ্ঞানসুলভ কোনো সামান্যীকরণ বা সাধারণ সূত্র নির্ণয় সম্ভব নয়। ঐতিহাসিক তাঁর অনুমান কৃত প্রকল্পের অনসুরণে তথ্য অনুসন্ধান ও তার ব্যাখ্যা করেন এবং এর ফলে নিরপেক্ষতা হ্রাস পায়।
এই মতের সমর্থকগণ ইতিহাসে ব্যক্তি মানুষের বা বিশেষ চরিত্রের ভূমিকাকেও অস্বীকার করতে চাননি – তাঁদের মতে অ্যারিস্টেটল, পেরিক্লিস, প্লেটো, জুলিয়াস সিজার, গৌতম বুদ্ধ, অশোক, আকবর, বা নেপোলিয়ন বা হিটলারের মতো চরিত্রকে সরিয়ে রাখলে ইতিহাসের ঘটনাক্রম পৃথক ধারায় প্রবাহিত হোতো। ইতিহাসে বিশেষ ঘটনা বা আকস্মিক কোনো অভিনব স্বতন্ত্র ঘটনার যে তাৎপর্য রয়েছে
ইতিহাস লেখন বা চর্চায় লেখকের নৈর্ব্যক্তিকতা ইতিহাসকে নিরস করে তুলতে পারে বলে এই মতে সমর্থকগণ মনে করেন এবং তারা বলেন যে ইতিহাসচর্চায় নৈর্ব্যক্তিক হওয়া সম্ভব নয়। হেগেল তেকে কোমটে, মার্কস থেকে ক্রোসে, স্পেনগলার থেকে টয়েনবি, র্যাঙ্কে থেকে মার্ক ব্লখ প্রত্যেক পন্ডিতই নিজ নিজ দর্শন দ্বারা পরিচালিত হয়েছেন এবং এটাই মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। যেমন র্যাঙ্কে নিজেই লিখেছিলেন যে ইতিহাসে ঈশ্বর বিরাজ করেন যা কিনা বিজ্ঞানসম্মত কোন ধারণা বা সত্য নয়।
বিউরি নিজেও বলেছিলেন যে কেবল তথ্য অনুসন্ধানকারী ঐতিহাসিকের তুলণায় দার্শনিক দিক থেকে ইতিহাসকে দেখা লেখক সৃষ্ট ইতিহাস অনেক বেশী অর্থবহ ও শিক্ষণীয় হয়ে ওঠে। একজন জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক রূপে অমলেশ ত্রিপাঠি যেভাবে গান্ধীজির আন্দোলনগুলিকে দেখবেন, মার্কসবাদী দর্শনের দ্বারা পরিচালিত হয়ে সুমিত সরকার সেভাবে দেখবেন না এবং কেমব্রীজ গোষ্ঠীর নেমিয়ার দর্শনের অনুসারী অনীল শীল তৃতীয় এক প্রকারে গান্ধীর আন্দোলনগুলিকে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করবেন। উল্লেখ্য যে তিনজনেই তথ্যনিষ্ঠ উপায়ে বিজ্ঞানসিদ্ধ পদ্ধতিতেই ইতিহাসটা করছেন কিন্তু যেহেতু ইতিহাসের বিষয় বস্তুজগত নয়, মানুষে চিন্তা ও আচরণ সেহেতু একই ঘটনার ভিন্নরূপ ব্যাখ্যা খুবই সম্ভব ও প্রাসঙ্গিক। এই বৈচিত্র ইতিহাসচর্চাকেই সমৃদ্ধ করে।
বস্তুত বিজ্ঞান যে প্রকৃতি ও বস্তুজগত নিয়ে আলোচনা করে তা মূর্ত, অন্যদিকে ইতিহাস এর বিষয়বস্তু বিমূর্ত – কারণ মানুষের কর্ম, – চিন্তা ও আচরণ কখনোই মূর্ত হতে পারে তাকে স্পর্শ করা যায়না, তাকে পরীক্ষা করা যায়না কেবল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও অনুমান – করা যায়। এই কারণেই মাও জে দক্ষের তিব্বত নীতি ভারত ও চীনের বুদ্ধিজীবি মহল ভিন্ন চোখে দেখে, বা ঠান্ডা যুদ্ধের দায়িত্বকে মার্কিনী, রূশ এবং সংশোধনাবদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়। মানুষের মননকে অনুধাবন করে ঘটনাবিশেষে তার বৈচিত্রপূর্ণ আচরণক ব্যাখ্যা করা কোন পরীক্ষণের পদ্ধতি দ্বারা সম্ভব নয়।
জি এম ট্যাভেলিয়ন এই কারণে লিখেছেন যে ইতিহাসে ঐতিহাসিকের মন ও মনন, তার অনুমান ইত্যাদি বৌদ্ধিক প্রক্রিয়াগুলি সক্রিয় থাকে যা তথ্যনিষ্ঠ হলেও কোনোভাবেই বস্তুনিষ্ঠ বা বিজ্ঞানসুলভ হতে পারে না। তিনি লিখেছেন, ” The function of physical sciences are mainly two direct utility in practical fields, and in more intellectual fields the deduction of the laws of cause and effect. Now history can perform neither of the two functions.. no one can by aknowledge of history however profound invent the steam engine or light a town or cure cancer or make wheat grow near the arctic circle.. history can not like physical science deduce causal laws of general appreciation… the law of gravitation may be scientifically proved becuase it is universal and simple. But the historical law that starvation brings on revolt is not proved; indeed the opposite statement that starvation leads to abject submission ins equally true in the light of past events.”
মূল্যায়ন
ইতিহাসের সাথে বিজ্ঞানের চর্চাগত দিক এবং চর্চার বিষয়বস্তুগত দিকের তারতম্যগুলি বেশ স্পষ্ট । চর্চার পদ্ধতিতেও ইতিহাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের পার্থক্য রয়েছে। আরোহ বা অবরোহ কোনো প্রকার যুক্তি দিয়েই ইতিহাসে স্বতঃসিদ্ধ বা অভ্রান্ত কোনো সত্যে উপনীত হওয়া যায় না। ইতিহাস লিখতে গিয়ে ঐতিহাসিকের মধ্যে যা কাজ করে তা মূলত অতীতের তথ্যের প্রতিফলিত ধারণাসমূহ। গবেষণাগারে বিজ্ঞানী যে সিদ্ধান্তে আসেন তা সর্বজনীন, অন্যদিকে গ্রন্থাগারে তথ্য বিশ্লেষণ করে ঐতিহাসিক যে সিদ্ধান্তে আসেন তা নমনীয় ও পরিবর্তনযোগ্য। সুতরাং, ইতিহাসচর্চার পদ্ধতি ও লক্ষ্য এবং বিজ্ঞানচর্চার পদ্ধতি ও উদ্দেশ্য উভয় অভিন্ন।