আদি মধ্যযুগের বর্ণ ও জাতি ব্যবস্থা
আদি মধ্যযুগে বর্ণ ও জাতি ব্যবস্থার আপাত মিল থাকলেও দুটি ধারণা সম্পূর্ণ এক নয়। এদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। বর্ণ চারটি কিন্তু জাতি অসংখ্য হাজার হাজার জাতি কোন না কোন বর্ণের অন্তর্ভুক্ত। প্রাচীন ভারতে বর্ণ ব্যবস্থাকে বিশেষ একক বলে মনে করা হতো। এক বর্ণের মধ্যে অনেক জাতির অবস্থান ঘটতো। ভারতীয় সমাজে বিদেশিদের আগমন এবং বিভিন্ন উপজাতির সমাবেশের ফলে জাতীয় সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ধর্মশাস্ত্র এই সমস্ত জাতিকে বর্ণ সঙ্গর আখ্যা দিয়ে খালি বর্ণ বিভক্ত ও সমাজে সঙ্গী করনের ব্যবস্থা করা হয়। সপ্তম শতকে গড়ার দিকে বর্ণ ও জাতির পার্থক্য ধীরে ধীরে কমে আসে। অধ্যাপক রামচরণ শর্মা, বর্ণ ও জাতির ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশ প্রসঙ্গে বলেছেন যে,”বর্ণ ও জাতি বাস্তবে এক ধরনের সামাজিক ভেদাভেদ এর দ্যোতক”।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের পরবর্তীকালে তাম্র শাসন জারি করে ভূমি দানের ঘটনা বৃদ্ধি পায়। এই জমি ও ক্ষমতা বন্টনের ফলে নতুন সামাজিক গোষ্ঠী ও শ্রেণী গড়ে ওঠে যা প্রচলিত চতুবর্ণ ব্যবস্থা থেকে আলাদা ছিল। গণপতি সম্পাদিত “ময়মত” পুথির অনুবাদে সম্রাট ব্রাহ্মণ নিপতি বৈশ্য সেনাপ্রধান শূদ্র সামন্ত প্রমুখদের বাস গৃহের আকৃতি উল্লেখ করা হয়েছে। অধ্যাপক শর্মা, আদি মধ্যযুগের সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে বৈদিক যুগের বর্ণভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থার স্বতন্ত্র তুলে ধরেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি মধ্যস্থভোগী ভূস্বামী বর্ণ ব্যবস্থা বহির্ভূত সামাজিক মর্যাদা ও ক্ষমতার উল্লেখ করেছেন। এক্ষেত্রে প্রচলিত বর্ণ ব্যবস্থা কোন গুরুত্ব ছিল না। প্রাপকের ভৌমিক অবস্থান ছিল তার মর্যাদার মাপকাঠি।
![]() |
|
আদি মধ্যযুগের বর্ণ ও জাতি ব্যবস্থা |
আদি মধ্যযুগের ভূমিদানব্যবস্থার ব্যাপক তার সূত্রে নতুন বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। ব্রাহ্মণ ও কর্মচারীদের ভূমি স্বত্ব দানের সঙ্গে সঙ্গে জমির রাজস্ব নির্ধারণ কৃষক নিয়োগ ভূমি স্বত্বাধিকারীর নথি রক্ষণাবেক্ষণ কাজের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছিল আর এই কাজের জন্য করনিক নামুক কর্মচারী নিয়োগ জরুরি হয়ে পড়ে এর থেকেই লিপিকর বা কায়স্থ সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে। সপ্তম থেকে দশম শতকে জমির স্বত্ব এবং সীমানা সংক্রান্ত বিতর্ক ক্রমে বৃদ্ধি পায় আর এ কারণেই সামাজিক কায়স্থ বালিকাদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় কায়স্থ ভারতের সমাজ ব্যবস্থা ও জাতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
আদি মধ্যযুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বৈশ্যদের অবনমন এবং শূদ্রদের উত্থান। ফলে উভয় বর্ণ একই সমান্তরাল রেখায় অবস্থান করতে শুরু করে। স্কন্দ পুরাণ থেকে জানা যায় যে কলিযুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের পতন ঘটেছিল। ঐতিহাসিক শর্মার মধ্যে একাদশ শতক থেকে বৈশ্যরা প্রথাগত ও আইনগত দিক থেকে শূদ্র হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। ফা হিয়েনের বিবরণী এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক নীহারঞ্জন রায় লিখেছেন যে, বাংলায় সেন বংশের রাজত্বকাল ব্যবসা বাণিজ্যের পতনের ফলে বাণিজ্য জীবনের অবস্থা সঙ্গীন হয়ে গিয়েছিল। ছিল নামমাত্র সুবর্ণ বণিক তৈল কাল, স্বর্ণকার, কর্মকার, কৈবর্ত সূত্রধর, পদ থেকে অবনমিত হয়েছিলেন।
সপ্তম শতক পরবর্তীকালে বাংলা দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদের অগ্রগতি ঘটেছিল কিন্তু এই দুই অঞ্চলে কখনোই বিদেশী জাতির দ্বারা গুরুতর আকারে আক্রান্ত হয়নি ফলে এই সকল অঞ্চলের স্থানীয় উপজাতি গোষ্ঠীর নেতারাই ক্ষত্রিয় রূপে স্বীকৃতি পেয়েছে শূদ্ররা ব্রাহ্মণ্যবাদী ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের সামাজিক মর্যাদা ছিল না। কৃষক কারিগর ও আদি উপজাতীয় মানুষরা শূদ্র শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ব্রহ্মপুরাণ ও বৃহৎ ধর্ম পুড়ানো সৎ শূদ্র ও অসৎ শূদ্র হিসেবে প্রায় ৫০ টি জাতির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে স্বর্ণকাররা সৎ শূদ্র শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হলেও পরে এদের ‘পতিত’ রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। মিশ্র শূদ্র জাতি হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায় স্বর্ণকার রাজমিস্ত্রি সূত্রধর চর্মকার মাংস বিক্রেতা ইত্যাদী।
রাজপুর জাতির সৃষ্টি জাতীয় স্তরের কাজকে তারান্তরিত করেছিল। চালুক্য প্রমুখ রাজপুত ক্ষত্রিয় ছিল বলে মনে করা হয়। হূণ, গুর্জর প্রভৃতি জাতির সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে। কখনো কখনো গুরুকেন্দ্রিক এক একটি ধর্ম সম্প্রদায় নিজেদের গুরুর পরিচয়কে ভিত্তি করে পৃথক পৃথক জাতি হিসেবে পরিচিত পায়। যেমন কর্নাটকের লিঙ্গয়েত ও বীর শৈব অথবা উত্তর ভারতে রাধা স্বামীন সম্প্রদায় স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে পরিচিত হয়েছে।