জাতীয়তাবাদ প্রসারে হিন্দু মেলার ভূমিকা আলোচনা করো
ড. বিমানবিহারী মজুমদার জানিয়েছেন যে বাংলাদেশে উনিশ শতকের ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার বিকাশ ঘটেছিল। জাতীয়তাবাদ ও গণতান্ত্রিক ধারণার প্রসারে যাঁরা নেতৃত্ব দেন তাঁরা হলেন রাজনারায়ণ বসু, দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিশিরকুমার ঘোষ, নবগোপাল মিত্র, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও রাজেন্দ্রলাল মিত্র। পশ্চিমি শিক্ষায় শিক্ষিত এসব বাঙালি মনীষীদের ধারণা হয় যে এদেশের তরুণ সমাজ নিজের দেশের ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। এই পরিণাম থেকে মুক্তি পেতে হলে জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে রাজনারায়ণ বসু বাঙালিদের মধ্যে জাতীয় ভাবের বিস্তার ঘটানোর জন্য একটি সভা স্থাপন করেন যার নাম হল সোসাইটি ফর দ্য প্রমোশন অব ন্যাশনাল ফিলিং এমং দ্য এডুকেটেড নেটিভস্ অব বেঙ্গল (Society for the promotion of national feeling among the educated natives of Bengal)। পশ্চিমের অনুকরণে উৎসাহী বাঙালি যুবকদের দৃষ্টি তিনি দেশের ঐতিহ্য, ইতিহাস, শিল্প, দেহচর্চা, চিকিৎসাবিদ্যা, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির দিকে ফেরাতে চেয়েছিলেন। এরই পরিণতি হল ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু মেলার প্রতিষ্ঠা (১৮৬৭-১৮৮০)।
হিন্দু মেলার প্রথম অধিবেশন বসেছিল ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের চৈত্র সংক্রান্তিতে। গোড়ারদিকে এর নাম ছিল চৈত্র মেলা, পরে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় হিন্দু মেলা। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু মেলার চতুর্দশ ও শেষ অধিবেশন হয়েছিল। এদেশের লোকজনের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন করা এবং এদেশের উন্নতি সাধন করা ছিল হিন্দু মেলার প্রধান লক্ষ্য। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বাল্যকথায় লিখছেন : ‘আমি বোম্বাইয়ে কার্যারম্ভ করার কিছু পরে কলিকাতায় এক স্বদেশি মেলা প্রবর্তিত হয়। বড়দাদা নবগোপাল মিত্রের সাহায্যে মেলার সূত্রপাত করেন….. কলিকাতার প্রান্তবর্তী কোনো একটি উদ্যানে বৎসরে বৎসরে তিন চারিদিন ধরে এই মেলা চলতো। সেখানে দেশি জিনিসের প্রদর্শনী, জাতীয় সংগীত, বক্তৃতাদি বিভিন্ন উপায়ে লোকের দেশানুরাগ উদ্দীপ্ত করবার চেষ্টা হত। প্রথমদিকে হিন্দু মেলার সম্পাদক ছিলেন গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবগোপাল মিত্র সহকারী সম্পাদক ছিলেন।
ঠাকুরপরিবার হিন্দু মেলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের স্বদেশাভিমানের কথা উল্লেখ করেছেন। ঠাকুর পরিবারের আর্থিক সাহায্য ও নেতৃত্ব না পেলে মেলা সফল হতে পারত না। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্মৃতিকথায় ‘লিখেছেন : ‘নবগোপাল একটা ন্যাশনাল ধুয়া তুলিল। আমি আগাগোড়া তারমধ্যে ছিলাম, সে খুব কাজ করিতে পারিত। কুস্তি, জিমন্যাস্টিক প্রভৃতি প্রচলন করার চেষ্টা তার খুব ছিল। কিন্তু কিরকম হওয়া উচিত, সেসব পরামর্শ আমার কাছ থেকে লইত’।` হিন্দু মেলা উপলক্ষ্যে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যে গান রচনা করেন তা বঙ্কিমচন্দ্রের অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করেছিল। গানটি হল ‘মিলে সব ভারত সন্তান, এক তান মন প্রাণ, গাও ভারতের যশোগান’। তরুণ রবীন্দ্রনাথ দুখানি কবিতা লিখে মেলায় পাঠ করে শুনিয়েছিলেন।
হিন্দু মেলায় জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হত। কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রত্যেক অধিবেশনে জাতীয় গৌরবের কথা স্মরণ করে বক্তৃতা দিতেন। তাছাড়া ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার বিশ্লেষণ থাকত। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব দেশীয় শিল্প আছে তাদের নমুনা এনে প্রদর্শনী করা হত। এসবের সঙ্গে থাকত মল্লযুদ্ধ, নৌ-বাইচ ও অন্যান্য শারীরিক কসরৎ। হিন্দু মেলা কার্যত ভারত মেলা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, একে জাতীয় মেলাও বলা হত। কাশী, জয়পুর, লখনউ, পাটনা ও কাশ্মীর থেকে বহুমূল্যের সুদৃশ্য শিল্পজাত ও সমস্ত রকমের কৃষিজ পণ্যের প্রদর্শনের ব্যবস্থা হত। কারু ও চারুশিল্পের সব নমুনা দর্শক এখানে একসঙ্গে দেখতে পেত।
হিন্দু মেলা ও জাতীয় মেলা বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের বিকাশে বিশিষ্ট অবদান রেখেছিল। এখানে যেসব দেশাত্মবোধক গান গাওয়া হত তা আজ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ বলে গণ্য হয়। রবীন্দ্রনাথ নিজে দুখানি গান গেয়েছিলেন। অস্বীকার করা যায় না যে এখানকার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল হিন্দু ঘেঁষা। মেলার প্রধান নেতা নবগোপাল মিত্র হিন্দুধর্মকে ভারতের জাতীয়তাবাদের প্রধান ভিত্তি বলে গণ্য করেন। হিন্দুধর্মকে বাদ দিয়ে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন। গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর মেলার দ্বিতীয় অধিবেশনে বলেছিলেন যে হিন্দু মেলা হল খাঁটি স্বদেশি মেলা। এরসঙ্গে ইউরোপীয়দের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
হিন্দু মেলা যে উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল তা পূরণ করা সম্ভব হয়, জাতির মনে ঐক্য ও স্বনির্ভরতার বীজ বপন করা হয়। সে যুগের বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার মনমোহন বসু তাঁর বক্তৃতায় স্বাধীনতার কথাও ব্যক্ত করেছিলেন। ভারতবাসীর মনে স্বাজাত্যবোধ ও স্বাবলম্বন বৃত্তির উন্মেষে হিন্দু মেলার কৃতিত্ব অসামান্য। সেযুগের শ্রেষ্ঠ মনীষীরা সকলে তাঁদের স্মৃতিকথায় হিন্দু মেলার কথা উল্লেখ করেছেন। জাতীয় ভাবের উদ্বোধনে এই মেলা যে কতখানি কার্যকর হয়েছিল ঐসব মনীষীদের রচনা থেকে তা বোঝা যায়।
শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় লিখেছেন যে কেশবচন্দ্রের বক্তৃতা, দীনবন্ধুর নাটক, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস, বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের সোমপ্রকাশ, মহেন্দ্রলাল সরকারের হোমিওপ্যাথি এইসব শিক্ষিত দলের মধ্যে নবভাব এনে দিয়েছিল। তেমনি আরও একটি কাজ নব আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করেছিল। এটি হল নবগোপাল মিত্রের হিন্দু মেলা ও প্রদর্শনী। দেশের সকল শ্রেণির লোক এই মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। বাঙালির ইতিহাসে এটি একটি প্রধান ঘটনা। বাঙালির মনে জাতীয় উন্নতির স্পৃহা জেগেছিল, এই স্পৃহা আর কখনও শেষ হয়নি। হিন্দু মেলার একটি বিশিষ্ট অবদান হল বাংলা ভাষার প্রসার ঘটানো। শিক্ষিত বাঙালি বাংলা ভাষায় কথা বলতে বা চিঠি লিখতে লজ্জা পেত। বাংলার মনীষীরা বুঝেছিলেন জাতীয় ভাষা হল জাতীয় মনোবৃত্তির স্বাভাবিক নিদর্শন। জাতীয় ভাষার উন্নতি ব্যতীত জাতির প্রতিষ্ঠা হয় না, জাতি উন্নতি করতে পারে না। হিন্দু মেলার অনুকরণে বারুইপুর ও দিনাজপুরে মেলা বসেছিল, হিন্দু মেলার প্রভাব শুধু কলকাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না।
হিন্দু মেলার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। জাতীয় মেলার আন্দোলনের ফলে সরকার বিদ্যালয় গুলিতে শারীরশিক্ষার সূচনা করতে বাধ্য হয়। এই সময় জাতীয় ভাবোদ্দীপক অনেক গান ও নাটক রচিত হয়, এপ্রসঙ্গে মনমোহন বসুর হরিশ্চন্দ্র নাটকের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। হিন্দু মেলা পর্বে ভোলানাথ চন্দর মুখার্জিস ম্যাগাজিনে প্রবন্ধ লিখে এদেশের শিল্প-বাণিজ্যের অধঃপতনের কথা তুলে ধরেন। সমস্যার সমাধান হিসেবে তিনি বিলিতি পণ্য বয়কট ও স্বদেশি ব্যবহারের প্রস্তাব দেন, জন্ম হল অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের। হিন্দু মেলার উদ্দেশ্য ছিল আত্মনির্ভরতার প্রতিষ্ঠা। পরবর্তীকালের স্বদেশি আন্দোলনের চিন্তাধারার সূত্রপাত ঘটেছিল হিন্দু মেলার মধ্যে। হিন্দু মেলা জাতীয় শিক্ষার সূচনা করেছিল। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে নবগোপাল মিত্র কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি স্থাপন করে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন।
হিন্দু মেলার পাঁচবছর পর জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়। হিন্দু মেলার কাজকর্মের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের তুলনা হয় না। জাতির সর্বাঙ্গীণ মুক্তি কামনায় হিন্দু মেলা প্রয়াস চালিয়েছিল, জাতীয় কংগ্রেসের উদ্দেশ্য ছিল সীমিত। জাতীয় মেলার উদ্দেশ্য ছিল গণজাগরণ ঘটিয়ে ঐক্যবদ্ধ, স্বাবলম্বী, শক্তিশালী জাতির প্রতিষ্ঠা করা। কংগ্রেস জাতীয়তাবাদ প্রচার করেছিল ঠিকই কিন্তু ‘আবেদন-নিবেদনের থালা সাজিয়ে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের পথ ধরেছিল। হিন্দু মেলা যে গণজাগরণ ঘটিয়েছিল তা ব্যর্থ। হয়নি। স্বদেশি ও বিপ্লবী আন্দোলনে জনগণ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। হিন্দু মেলার ঐতিহ্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। হিন্দু মেলা জাতীয়তাবাদের বিকাশে বিশিষ্ট অবদান রেখেছিল।