দক্ষিণ ভারতের মন্দির স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য গুলি বর্ণনা করো
ভূমিকা
গুপ্তযুগের শেষদিকে থেকে প্রায় এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে দক্ষিণ ভারতের মন্দির স্থাপত্য অব্যহত ছিল। দক্ষিণের শিল্পসৃষ্টি চালুক্য, রাষ্ট্রকূট ও পল্লব রাজাদের দুটি মহৎ ধারাকে অবলম্বন করে বেড়ে ওঠে। প্রসঙ্গত, চালুক্য-রাষ্ট্রকুট ও পল্লব শিল্প প্রায় সমসাময়িক কালের এবং পল্লব রাজাদের শিল্পসৃষ্টি চালুক্যদের পরবর্তী শিল্পসৃষ্টির উপর বিশেষ প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়।
দক্ষিণ ভারতের মন্দির স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য
লাদখান মন্দির : আইহোলির লাদখান মন্দিরটি চালুক্যদের আমলে (৪৫০ খ্রিস্টাব্দ) নির্মিত হয়। মন্দিরটি পাহাড় কেটে তৈরি দক্ষিণ ভারতের মন্দির স্থাপত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মন্দিরের সংলগ্ন মন্ডপ নীচু সমতল ছাদবিশিষ্ট। মন্দিরটি বর্গাকার, উচ্চতা ৫০ ফুট। মন্দিরটির গর্ভগৃহ বর্গাকার এবং পরবর্তীকালে এতে একটি ছাদযুক্ত বারান্দা সংযোজিত হয়েছে। এটি একটি সূর্যমন্দির। প্রধান মন্দিরের তিন দিক দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। চতুর্থ দিকটি অর্থাৎ পূর্বদিকটিতে খোলা বারান্দা, যার স্তম্ভগুলিতে নদীদেবীর মূর্তি উৎকীর্ণ। ভিতরের কক্ষটি বর্গাকৃতি স্তম্ভযুক্ত একটি বৃহৎ নন্দীর অবস্থান কক্ষের মধ্যস্থলকে আবৃত করেছে। প্রান্তবর্তী গর্ভগৃহ কেন্দ্রীয় বৃহৎ কক্ষটির পিছনের দেওয়াল সংলগ্ন। সৌধটির বহির্ভাগের দেওয়ালের কোনগুলি থেকে উদ্গত স্তম্ভসদৃশ্য অলঙ্করণের মধ্যে দ্রাবিড়শৈলীর সূত্রপাত লক্ষ্য করা যায় (ক্রমশ সংকীর্ণ অগ্রভাগযুক্ত স্তম্ভ), শীর্ষদেশের ‘পীঠিকা’ লতাপাতা অলঙ্করণ যুক্ত ও ব্র্যাকেটের ভার বহনকারী। ছাদটি বৃহৎ সমতল ফলকের প্রশস্ত সারি দ্বারা যুক্ত।
![]() |
লাদখান মন্দির |
দূর্গামন্দির : আইহোলির দূর্গামন্দিরটি ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত। এর একদিকে অর্ধ-বৃত্তাকার (৬০ ফুট X ৩৬ ফুট); সংলগ্ন বারান্দাটি পূর্বদিকে প্রসারিত (২৪ ফুট X ৮৪ ফুট) প্রশস্ত। মন্দিরটির ভিত কারুকার্যবিশিষ্ট। এর সমতল ছাদ ভূমিতল থেকে ৩০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। দক্ষিণ ভারতের মন্দির স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য হল নতুন সংযোজন— ‘অন্তরাল’ অর্থাৎ গর্ভগৃহ ও মন্ডপের মধ্যবর্তী গৃহ। গর্ভগৃহের উপর শিখরটি দন্ডায়মান। সংলগ্ন বারান্দার ছাদটি ঢালু ফলক দ্বারা নির্মিত। ফলকগুলি বৃহদাকার বর্গাকৃতি ও ব্র্যাকেটযুক্ত স্তম্ভসারির উপর ন্যস্ত
পট্টদকলের মন্দিরসমূহ : সপ্তম শতাব্দী থেকে পাহাড় কেটে মন্দির নির্মাণরীতি প্রবর্তিত হয়। পট্টদকলে সপ্তম শতাব্দীর মোট ১০টি মন্দির অবস্থিত। এর মধ্যে ছ’টি মন্দির দ্রাবিড় রীতি অনুযায়ী নির্মিত। পটদকলে জন্মলিঙ্গ, কাশী বিশ্বনাথ, গলগনাথ ও পাপনাথের মন্দিরে (৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) ‘ত্রিরথ’ ও ‘পঞ্চরথ’ ভিত্তি-সংস্থানের শিখর যুক্ত উত্তর ভারতীয় পটদকলের গলগনাথ মন্দির মন্দির রীতির প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। পাপনাথের মন্দিরটি ৯০ ফুট দীর্ঘ, কিন্তু সামঞ্জস্যপূর্ণ উচ্চতার অভাব রয়েছে। এর শিখর উত্তর ভারতীয় হলেও ভার্তি ক্ষুদ্র ও এর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যহত। প্রধান কক্ষটি ও গর্ভগৃহের মধ্যবর্ত অন্তরাল বেশ বড়, আরেকটি কক্ষের সংযোজন। মন্দিরের বাইরের প্রাচীরের গায়ে খোদিত কুলুঙ্গিগুলি মন্দিরের পুনরাবৃত্তি।
বীরুপাক্ষ মন্দির : দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যের মহিষী লোক মহাদেবী কর্তৃক নির্মিত বীরুপাক্ষ মন্দিরটি কাঞ্চীর কৈলাশনাথ মন্দিরের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। ব্যপ্তি ১২০ ফুট। মন্দিরের অঙ্গগুলির সুষম বিন্যাস লক্ষ্যণীয়। দক্ষিণী রীতির প্রাচীর বেষ্টিত অঙ্গন, চারপাশে ছোটো ছোটো বহু মন্দির, ‘গো-পুরম’(মন্দিরের প্রবেশদ্বার), উঁচু শিখর ও সুন্দর মন্ডপযুক্ত মন্দিরটি চালুক্য স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন। মন্ডপ থেকে স্বতন্ত্র মন্দিরের একটি প্রদক্ষিণ পথ আছে। স্তম্ভসারি যুক্ত মন্ডপের ভারী প্রাচীরের মাঝে মাঝে পাহাড়ের ভিতর ছিদ্রযুক্ত মন্দির রয়েছে। মন্দিরের শিখরটি বর্গাকৃতি এবং ধাপে ধাপে উঠে গেছে। প্রত্যেকটি ধাপ অপরটি থেকে স্বতন্ত্র এবং যথেষ্ট উচ্চতাসম্পন্ন। ভাস্কর্যের সংযত স্রোত বীরুপাক্ষ মন্দিরের স্থাপত্যের মধ্যে চিরবহমান।
![]() |
বীরুপাক্ষ মন্দির |
দশাবতার মন্দির (ইলোরা গুহা) : ইলোরার দশাবতার মন্দিরটি চালুক্যদের তৈরি সর্ববৃহৎ ও শ্রেষ্ঠ। )) এই মন্দিরটির একদিকে স্তম্ভযুক্ত বারান্দা ও অন্যদিকে গর্ভগৃহ। পাথর খোদাই প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকলে একটি উন্মুক্ত প্রাঙ্গন। এর মাঝখানে একটি স্বতন্ত্র মন্দির (সম্ভবত নন্দীমন্ডপ )। এরপর দ্বিতল মন্দিরের সম্মুখভাগ স্তম্ভগুলি বর্গাকার, প্রত্যেক তলে রয়েছে স্তম্ভসারি যুক্ত বৃহৎ কক্ষ। স্তম্ভগুলি সমান্তরাল চতুস্পার্শ যুক্ত। এদের শীর্ষদেশ ও পীঠিকা অনাড়ম্বর। চারদিকের বেষ্টনী প্রাচীরের গায়ে স্তম্ভ সদৃশ্য অলঙ্করণের মাঝে মাঝে পাথর খোদাই করা প্যানেলে বিশালাকার ভাস্কর্য বিন্যস্ত। বৈষ্ণব ও শৈব ভাস্কর্যগুলি এখানে শোভিত হয়েছে। এই ভাস্কর্যগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিরণ্যকশিপুর মৃত্যু।
দুমরলেন মন্দির ( ইলোরা) : দুমরলেন মন্দিরটির গঠনশৈলী ক্রুশাকার। এর তিনটি প্রবেশপথ একটি সামনে ও দুটি পাশে। মন্দিরটি অপেক্ষাকৃত বৃহত্তর। বিভিন্ন দিক থেকে মন্দিরে আলো প্রবেশ করিয়ে মন্দির চত্ত্বরটিকে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। প্রবেশদ্বারে একটি সোপান দিয়ে উঠতে হয়। কেন্দ্রবর্তী মন্দিরে যেতে হলে আংশিক বেষ্টন করে অবস্থিত প্রধান কক্ষটি অতিক্রম করতে হয়। এছাড়াও একটি আয়তাকার সুন্দর দরদালান (১৫০ ফুট X ২৫ ফুট) রয়েছে। এটি স্তম্ভ সারি দ্বারা তিনভাগে বিভক্ত। তিনটি প্রবেশপথের মুখেই রয়েছে স্তম্ভসারি যুক্ত খোলা জায়গা। যেখানে সোপান বেয়ে উঠতে হয়। সোপান শ্রেণির দু’পাশে পাদপীঠে আসীন দুটি সিংহমূর্তি। মন্দিরের ভিতরে স্তম্ভগুলি ১৫ ফুট উঁচু ও ভিত ৫ ফুট প্রশস্ত।
এলিফ্যান্টা মন্দির : দক্ষিণ ভারতের মন্দির স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন এলিফ্যান্টা মন্দির। বোম্বাইয়ের এলিফ্যান্টা দ্বীপে ২৫০ ফুট উঁচু এক পাহাড়ের উপর অষ্টম শতাব্দীর শেষভাগে একটি গুহামন্দির লক্ষ্য করা যায়। এই গুহামন্দিরটি দৈর্ঘ্যে ১৩০ ফুট এবং প্রস্থ ১২৯ ফুট। সারি সারি বিশাল স্তম্ভের উপর মন্দিরটি ভর করে আছে। ইলোরার মতই এই মন্দিরটিও পাহাড় খোদাই করে রচিত হয়েছে। মন্দিরের মন্ডাপে প্রবেশ করতে হয় উত্তর দিক থেকে। মন্ডপগৃহের দক্ষিণে একটি গর্ভগৃহে এলিফ্যান্টার জগৎ বিখ্যাত ‘ত্রিমূর্তি’ বিরাজিত। মন্দিরটির পিছনের দেওয়ালে ভাস্কর্যের প্রাচুর্য লক্ষ্যণীয়। এলিফেন্টায় একটি চতুর্মুখ মন্দির এবং মূল মন্ডপের পূর্ব ও পশ্চিমে দূর্গা ও শিবের দুটি ছোটো মন্দির দক্ষিণ ভারতের মন্দির স্থাপত্যের আরেক বৈশিষ্ট্য ।