লোকশিল্প ও সুকুমার শিল্পের মধ্যে তুলনামূলক পার্থক্য:
লোকশিল্প
কোনো এক অঞ্চলের মানুষের বা মানবগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনেরকাজ কর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, ক্রীড়া-বিনোদন, শিল্প-সংস্কৃতি, জীবন-জীবিকা ইত্যাদি ধারাবাহিকভাবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকলে তা ক্রমে লোকায়ত শিল্পে পরিণত হয়—এই শিল্পই লোকশিল্প (Folk Art)। লোকশিল্প পরিকল্পিত ও পরিশীলিত সৃষ্ট শিল্প নয়। গ্রামীন মানুষের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, সংস্কারকে ঘিরে বংশানুক্রমিকভাবেই এই শিল্পের উদ্ভব। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের মাধ্যমে কোনো বিশেষ অঞ্চলের সমাজ পরিচয়, সংস্কৃতিমনস্কতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই শিল্পের ধারাবাহিকতায় চিত্রকলার উপস্থিতি খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ।
সুকুমার শিল্প
সুকুমার শিল্পকলার উৎপত্তি ও ব্যাপ্তির ইতিহাস ঠিক লোকশিল্পের বিপরীত। মানুষের সুকুমার বৃত্তির স্বতঃস্ফূর্ত রোনছনে ও সৃজনশীল সৃষ্টির স্পৃহায় যে শিল্পকর্ম সৃষ্টি হয় তাই ‘সুকুমার শিল্প’ (Fine Arts) বহুমাত্রিক সুকুমার শিল্পের পরিবৃত্তে নৃত্য, সঙ্গীত, কাব্য-সাহিত্য, চিত্রকলা-ভাস্কর্য ইত্যাদি সূক্ষাতিসূক্ষ্ম ভাবনাযুক্ত সকল শিল্পকর্মই অন্তর্ভুক্ত। সুকুমার শিল্পের অন্যতম পদ ‘সুকুমার শিল্পকলা’। এই শিল্পকলার উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র বিনোদন কিংবা নান্দনিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মানুষের মনের শূন্যতাকে পরিপূর্ণ করে রসাস্বাদনের উপযুক্ত করে তোলার সঙ্গে তাকে আন্দঘল সম্পৃক্ত করাই সুকুমার শিল্পকলার কাজ।
লোকশিল্প ও সুকুমার শিল্পের মধ্যে পার্থক্য উভয়েই ‘শিল্প’-র পদবাচ্য হলেও বহুমাত্রিক ব্যবধান উভয়শিল্পকেই নিজস্বতায় পুষ্ট করেছে বিভিন্নভাবে।
লোকশিল্প ও সুকুমার শিল্পের মধ্যে তুলনামূলক পার্থক্য:
লোকশিল্প | সুকুমার শিল্প |
---|---|
১। কোনো এক অঞ্চলের বিশেষ জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, মূল্যবোধ, সংস্কার, শিল্প-সংস্কৃতিমনস্কতার ভিত্তিতেই লোকশিল্পের উৎপত্তি। লোক শিল্পকলা-লোক সংস্কৃতির রূপকেই মূর্ত করে। | ১। সুকুমার শিল্পকলার (Fine Arts)-র উৎপত্তি, সুকুমার বৃত্তির স্বতঃস্ফূর্ত রোমন্থনে ও সৃজনশীল সৃষ্টির অদম্য স্পৃহায়। সুকুমার শিল্পকলার সাথে লোক শিল্পকলার কোনো সম্পর্ক নেই। |
২। লোক শিল্পকলায় পরিকল্পিত মানসিকতার পরিবর্তে বংশানুক্রমিক প্রবাহমানতা লক্ষ্য করা যায়। | ২। সুকুমার শিল্পকলায় পরিকল্পিত মানসিকতার পূর্ণ প্রতিফলন বিদ্যমান। |
৩। লোকশিল্পকলার ধারার পরিবর্তন সাধিত হয় না বললেইচলে। যাও বা হয় তাও অতি নগন্য। স্থান, কাল, পাত্রের পরিবর্তনে লোকশিল্পের স্থিতিরূপের সুনির্দিষ্টতা বহাল থাকে। | ৩।সুকুমার শিল্পকলার ঘরানার (Traditional Style) পরিবর্তন একটি নৈমিত্তিক (Casual) ঘটনা। এক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতার অনুশাসন দীর্ঘস্থায়ী নয়। স্থান, কাল, পারে পরিবর্তনে সুকুমার শিল্পকলার রূপও পরিবর্তিত হয়। |
৪। লোকশিল্পের বিষয়বস্তু অত্যন্ত সাদাসিধে। সকল শ্রেণিরদর্শকই লোকশিল্পের রসাস্বাদনে সক্ষম। | ৪। সুকুমার শিল্পকলার বিষয়বস্তু যেমন বুদ্ধিদীপ্ত তেমন জটীল। তাই সুকুমার শিল্পের রসাস্বাদন সকলের পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। একমাত্র শিল্পরসোত্তীর্ণ ব্যক্তি ব্যতিরেকে সুকুমার শিল্পের রসাস্বাদন সম্ভব নয়। |
৫। লোকশিল্প তথা শিল্পকলার সঠিক দৃষ্টিকোন চিহ্নিত করা যায় না। | ৫। সুকুমার শিল্প তথা শিল্পকলার উৎপত্তিকাল সুনির্দিষ্ট। সামান্য পরিশ্রম করলেই শিল্পকলার উৎপত্তির সঠিক দিন কাল জানা সম্ভব। |
৬। লোকশিল্পের ক্ষেত্র বিশ্বময় বিস্তৃত। ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ইতাদির কারণে এর ভিন্নতা থাকলেও বৈচিত্রের সাথে অকৃত্রিম মৌলিক মাধুর্যতার মধ্যে বিকাশেই লোকশিল্পের পূর্ণ সার্থকতা। | ৬। সুকুমার শিল্পকলার ব্যপ্তির ক্ষেত্র তুলনামূলকভাবে সীমাবদ্ধ। সুকুমার শিল্পকলা দেশ ও কালের সীমানা পেরিয়ে শিল্পের পটভূমিতে বিশ্ব ঐক্য স্থাপনে সক্ষম। |
৭। লোকশিল্পকলা গোষ্ঠী শিল্পমনস্কতার পূর্ণ সার্থকতা। | ৭। সুকুমার শিল্পকলা ব্যক্তি শিল্পমনস্কতার গৌরবময় প্রয়াস। |
৮। লোকশিল্প অকৃত্রিম মৌলিকতায় পুষ্ট ও সৃজনশীল মানসিকতার উন্মুক্ত ফলিত দর্পণ। | ৮। সুকুমার শিল্প সর্বক্ষেত্রেই মৌলিক নাও হতে পারে। চলমান ধারনার বা ঘরানার প্রভাব সুকুমার শিল্পকে নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ করে। |