গুপ্ত যুগের শিল্পকলা
সাহিত্য, দর্শন, শিক্ষা ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কেবল গুপ্তযুগে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটেছিল তাই নয়, গুপ্ত যুগের শিল্পকলা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। বস্তুত, গুপ্ত যুগে সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশে শিল্পকলার এক যথেষ্ট স্থান আছে। গুপ্ত যুগের স্থাপত্য ও ভাস্কর্য এবং চিত্রকলার সমন্বয়ে সৃষ্ট শিল্পকলা এই যুগকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে।
খ্রিস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর যমুনা তীরবর্তী মথুরা শিল্পকলা, কুষাণ, গান্ধার অঞ্চলের উত্তর-পশ্চিমের শিল্পকলা এবং দক্ষিণে অমরাবতী শিল্পকলা, নাগার্জুনকোন্ডা প্রভৃতি শিল্পকলা খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যভাগে এনে উপনীত করে। এইসময় বহু ভাবধারা ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের মধ্য দিয়ে ভারতীয় শিল্পীদের নিজেদের পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়েছিল। এমতাবস্থায় খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর প্রথমভাগে গুপ্ত রাজাদের উত্থান ভারত ইতিহাসে এক নতুন যুগের উন্মেষ ঘটায়। গুপ্ত সম্রাটদের শৌর্য ও পরাক্রম শক, হুন প্রভৃতি বৈদেশিক শক্তিকে পরাভূত করে।
দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হলে এবং অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যি সমৃদ্ধি এলে মহান শিল্পবিকাশের উপযুক্ত ক্ষেত্র রচিত হয়। ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতির উৎকৃষ্ট চর্চার পাশাপাশি ভাস্কর্য, চিত্রকলা, স্থাপত্য— নন্দনতত্ত্বের এই শাখাগুলিতেও গুপ্ত যুগে চরম উন্নতি সাধিত হয়। জাতীয় ভাষারূপে প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতে অলংকারবহুল সাহিত্যের যে প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়, তারই মূর্তরূপ যেন ফুটে ওঠে গুপ্ত যুগের শিল্পকলার মধ্যে।
![]() |
গুপ্ত যুগের শিল্পকলা |
পূর্ববর্তী শতাব্দীসমূহের সৌন্দর্যের সাধনার ধারাবাহিকতা থেকে গুপ্ত যুগে নন্দনতত্ত্বের মূলনীতিগুলি প্রথম একটি নির্দিষ্ট রূপ লাভ করে। এর ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল ভারতীয় শিল্পের ‘ধ্রুপদী’ (Classical) ঘরানা। এর বৈশিষ্ট্য হল, একাধারে পেলবতা ও শক্তিমত্তা এবং অন্যদিকে আধ্যাত্মিকতা ও ইন্দ্রিয়পরায়ণতা। সরসীকুমার স্বামীর ভাষায়— ‘Its inheritance was indigeneous, early Asiatic, Persian and Hellenestic.’।
মথুরা শিল্পের আদিমতা মার্জিত হয়ে, গান্ধার শিল্পের দেহসর্বস্বতা পেলবতা পেয়ে, অমরাবতীর ইন্দ্রিয়পরায়ণতা মধুরিমায় সিক্ত হয়ে গঙ্গা নদীর অববাহিকা অঞ্চলে একটি নতুন রূপ গ্রহণ করেছিল। শিল্পের এইরূপ ভারতীয়করণ জন্ম দিয়েছিল এক জাতীয়তাবাদী ভাবধারার। গঙ্গা উপত্যকা অতিক্রম করে তা ক্রমশ ভারতের অন্যত্রও (শ্যামদেশ, সিংহল, ব্রহ্মদেশ, সুমাত্রা, যবদ্বীপ, বালিদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, বোর্ণিও ইত্যাদি) ছড়িয়ে পড়ে। ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে দাক্ষিণাত্যে পল্লব ও চালুক্য রাজাদের শিল্পকীর্তি এবং সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর ভাস্কর্য, স্থাপত্য ও চিত্রকলা গুপ্তযুগের শিল্পের দ্বারায় বহুলাংশে প্রভাবান্বিত ছিল।