ত্রিপিটক কাকে বলে । টীকা লেখ ত্রিপিটক
অজাতশত্রুর আমলে মহাকাশ্যপের নেতুত্বে রাজধানী রাজগৃহে প্রথম বৌদ্ধ সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়। এখানে বুদ্ধের বাণীগুলি তিনটি খণ্ডে বিভক্ত করা হয়। বিভিন্ন বৌদ্ধ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় ভিন্ন ভাবে তাদের ধর্মগ্রন্থের ভাগ করে ৯টি বা ১২ টি অঙ্গ বা ৩টি পিটক। তিনটি পিটক বা সংকলকে একসাথে ত্রিপিটক বলা হয়। এই ত্রিপিটকের পালি, চৈনিক ও তিব্বতীয় সংস্করণ রয়েছে। পালি (মগধ ও পূর্ব ভারতের বিভিন্ন ভাষাকে নিয়ে গঠিত) ভাষায় রচিত থেরবাদী সম্প্রদায়ের ত্রিপিটকই সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। ত্রিপিটক তিনটি গ্রন্থে বিভক্ত – সূক্ত পিটক, বিনয় পিটক এবং অভিধর্ম পিটক।
ত্রিপিটক রচনার সময়কাল
বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুসারে সূত্ত ও বিনয় পিটক বুদ্ধের জন্মের এক বছর পর রাজগৃহের প্রথম বৌদ্ধ – মহাসঙ্গীতি এবং ১০০ বছর পর বৈশালী নগরে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বৌদ্ধ মহাসঙ্গীতিতে পাঠ করা হয়েছিল। তবে পন্ডিতগণ মনে করেন যে সূত্র ও বিনয় পিটকের রচনা খ্রিস্ট পূর্ব পঞ্চম শতকে শুরু হলেও তা খ্রিস্ট পূর্ব তৃতীয় শতকে অশোকের রাজত্বকালেও সংকলিত হয়েছিল খুদ্দক নিকায়ের প্রায়াংশ খ্রিস্ট পূর্ব তৃতীয় শতকে রচিত হয়েছিল। অভিধর্ম পিটকের অন্তর্ভূক্ত কথাবথুও খ্রিস্ট পূর্ব তৃতীয় শতকের সৃষ্টি। পরবর্তীকালে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে সিংহল রাজা বস্তুগমনির পৃষ্ঠপোষকতায় ত্রিপিটক লিখিত হয় এবং তখন সম্ভবত কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়। সামগ্রিকভাবে আদি পালি ভাষার ত্রিপিটক খ্রিস্ট পূর্ব পঞ্চম থেকে তৃতীয় শতকের মধ্যে সংকলিত হয়েছিল।
সূক্ত পিটক
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকের প্রত্যেকটি কয়েটি গ্রন্থে বিভক্ত এই গ্রন্থ বা সংকলগুলিকে বলা হয় নিকায় গ্রন্থ। সূত্র পিটকের যেমন পাঁচটি নিকায় গ্রন্থ রয়েছে দীর্ঘ নিকায়, মজঝিম নিকায়, সংযুক্ত নিকায়, অঙ্গুত্তর নিকায় এবং ক্ষুদ্দক নিকায়। বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন বিষয়, বিশ্বসৃষ্টি, ঈশ্বরলাভের উপায়, পুর্নজন্মা, আত্মসংযম, সন্ন্যাস, আত্মা সম্পর্কিত তত্ত্ব, ইত্যাদি নিকায় গ্রন্থগুলির বিষয়বস্তু। সূত্ত পিটকের অন্তর্ভূক্ত দীর্ঘ নিকায়ে ৩৪ টি সূক্ত রয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাপরিনিব্বান সুভ যেখানে বুদ্ধের শেষ জীবনের কথা বলা হয়েছে। মমি নিকায়তে ১৫২ টি এবং অঙ্গুত্তর নিকায়তে ২৩০০ সূক্ত রয়েছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্দক বা খুদ্দক নিকায়ে বৈচিত্রপূর্ণ বিষয়বস্তুর সংকলন করা হয়েছে।
সূত্ত পিটকের অন্তর্ভূক্ত বিভাগগুলি
১) খুদ্দক পাঠ বা মন্ত্রের সংকলন, ২) ধম্মপদ ৪২৩ শ্লোকে বৌদ্ধ ধর্মের নৈতিক শিক্ষা, ৩) উদ্দান বুদ্ধের জীবন ও উপদেশ, ৪) ইতিবুখক – বুদ্ধের বক্তব্যের আকারে শিক্ষার সংকলন, ৫) সুভনিপাত কাব্যাকারে আদি বৌদ্ধ ধর্মের স্বরূপ, ৬) বিমানবেন্ধু – ভালো কাজ করলে স্বর্গলাভ, ৭) পেতবেথু খারাপ কাজ করলে দুঃখভোগ, ৮) থেরগাথা ভিক্ষু/ খেরদের রচিত গাধা বা কবিতার সংকলন, ৯) থেরীগাথা ভিক্ষুণীদের রচিত গাথা বা কবিতার সংকলন, ১০) জাতক গাধা (সারাংশ) এবং গদ্যে (ভাষ্য) রচিত গৌতম বুদ্ধের পূর্বজন্মের ৫০০ কাহিনী, জন্মান্তরে ভোগ্য সৎকর্মের সুফল সম্পর্কে বলা হয়েছে, ১১) নিদ্দেস বা মহানিদ্দেস – সুভনিপাতের ভাষ্য, ১২) পটিসম্ভিদাম দার্শনিক তত্ত্ব, ১৩) অপদান পূর্ব জন্মের সংৎকর্মের বিবরণ, ১৪) বুদ্ধবংশ – গৌতম বুদ্ধের পূর্ববর্তী ২৪ জন বুদ্ধের কাহিনী, ১৫) চরিয়া পিটক শ্লোকে ৩৫টি জাতক যেখানে দেখানো হয়েছে বুদ্ধ পূর্ব ১০টি জন্যে পারমিতার অধিকারী ছিলেন।
বিনয়পিটক
ত্রিপিটকের দ্বিতীয় গ্রন্থ বিনয়পিটকে বৌদ্ধ সংঘের ভিক্ষু বা সন্ন্যাসী ও ভিক্ষুণী বা সন্ন্যাসিনীদের জন্য নিয়মকানুন ও আচার সংকলিত আছে। বিনয় পিটকের মধ্যে রয়েছে- ১) সূত্তবিভঙ্গ সূত্তের ব্যাখ্যা, যেখানে ২২৭ প্রকার দোষ ও তার প্রায়শ্চিত্তের কথা রয়েছে ২) খন্দকা দুটি ভাগে বিভক্ত মহাব ও চুন্নবক্স যেখানে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের জীবনযাপন, আহার, পোষাক, বাসস্থান ইত্যাদি বিষয়ে বলা হয়েছে এবং ৩) পরিবার পাঠে উপরোক্ত বিষয়ের সারসংক্ষেপ করা হয়েছে।
অভিধর্ম পিটক
অভিধর্ম পিটকের অর্থ হল উচ্চতর ধর্মের সংকলন। ঈষৎ পরবর্তীকালের রচনা অভিধর্ম পিটকে সূত্ত পিটকের অনুশাসনগুলিকে তালিকা, সংক্ষিপ্তসার বা সারাংশ এবং প্রশ্ন উত্তরের মধ্যে দিয়ে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে দার্শনিক তত্ত্বও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অভিধর্ম পিটক সাতটি প্রকরণে বিভক্ত -ধৰ্ম্ম সঙ্গণি, বিভঙ্গ, ধাতুকথা, কথাবন্ধু, যমক, পট্রান, ইত্যাদি। কথাবত্থু তৃতীয় বৌদ্দ মহাসঙ্গীতির সভাপতি মোগলিপুত্ত তিসসের যুক্তি-তর্কের সংকলন।