ইতিহাস রচনায় একজন ঐতিহাসিক যে সব উপাদান ব্যবহার করেন সেগুলি উল্লেখ করো
ইতিহাসের লেখক রূপে ঐতিহাসিকও একটি নির্দিষ্ট সময়ে বসবাস করেন এবং সেই সময় বা কাল বা যুগের চেতনা, ভাবনা ও মানসিকতাকে প্রতিনিধিত্ব করেন অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির সঙ্গে তাঁর সময়ের ব্যবধান থাকে, ঘটনা যত পুরনো সময়ের ব্যবধান তত বেশী। সুদূর বা নিকট উভয় প্রকার অতীতকেই যথার্থভাবে বা র্যাঙ্গের ভাষায় ঠিক যেভাবে ঘটেছিল সেইভাবে উপস্থাপন করার জন্য ঐতিহাসিককে নির্ভর করতে হয় আকর তথ্যসূত্রের উপর যাকে ঐতিহাসিক পরিভাষায় ইতিহাসের উপাদান বলা হয়ে থাকে।
প্রাথমিক বা গৌণ (যা প্রাথমিক ভাষ্যের উপর ভিত্তি করে রচিত), সমসাময়িক কালে বা পরবর্তী কালে রচিত বা সৃষ্ট যে কোন পরীক্ষিত স্বাক্ষ্যপ্রমাণ ঐতিহাসিক তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে উপস্থাপন করেন এই স্বাক্ষ্যপ্রমাণ সরবরাহকারী যে কোন কিছুই উপাদান রূপে স্বীকৃত। সাম্প্রতিক কালে রচিত ‘History A Very Short Introduction’ নামক গ্রন্থে জন আর্নল্ড লিখছেন যে ঐতিহাসিক উপাদান অতীতের ঘটনার স্বাক্ষ্য বহনকারী বা উল্লেখকারী যা কিছুই হতে পারে সনদ, জমি হস্তান্তরের দলিল, বিচারলয়ের যে কোন নথি, বই বা গ্রন্থের শেয়ার, মূলা, মালপত্র, মানুষ, জনসংখ্যা, ইত্যাদি সংক্রান্ত নথি তালিকা, গল্প, পুরাকথা, প্রবাদ প্রবচন, কবিতা, জীবনচরিত, স্মৃতিকথা, চিত্র, স্থাপত্য, ভাষ্কর্য, ধনী ও গরিবদের আবাসের অবশেষ, যে কোন বস্তুগত সংস্কৃতির অবশেষ এবং এরকম আরও হাজার হাজার বস্তু।
লিখিত বা সাহিত্যগত উপাদান
লিখিত বা সাহিত্যগত উপাদান অর্থাৎ যা লিখিত আকারে রয়েছে এবং যা থেকে ইতিহাসের তথ্যসূত্র আহরণ করা যায়। (যেমন- মৌর্য যুগের ইতিহাস এর ক্ষেত্রে মেগাস্থেনিস রচিত ইন্ডিকা, বা কৌটিলা রচিত অর্থশাস্ত্র) এবং খ) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান অর্থাৎ প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে মাটির উপর থেকে বা উৎখননের মাধ্যমে মাটির তলা থেকে প্রাপ্ত মানুষের বস্তুগত সংস্কৃতির চিহ্ন বহনকারী স্বাক্ষ্য (মৌর্য যুগের ক্ষেত্রে পাটলিপুত্র নগরের ধ্বংসাবশেষ যা পার্টনার নিকট কুমরাহার নামক স্থানের উৎখননে আবিষ্কৃত হয়েছে)। মৌর্য যুগের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে সম্রাট অশোকের অনুশাসনগুলিও লেখমালার অন্তর্ভূক্ত এবং সাধারণভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান রূপে পরিগণিত, কিন্তু একইসাথে এগুলি সাহিত্যগত উপাদান কারণ এগুলি হয় পাথরের স্তম্ভে বা লৌহস্তম্ভের উপর খোদাই করে লিখিত যার সাহিতাগত মূল্য রয়েছে।
প্রাথমিক উপাদান (Primary Sources)
প্রাথমিক উপাদান অর্থাৎ যে উপাদান অতীতের কোন ঘটনার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষ্য বহনকারী এবং ঘটনার সমসাময়িক বা প্রায় সমসমায়িক কালে সৃষ্ট; অন্যভাবে বললে কোন একটি ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ প্রদানের ক্ষেত্রে এই প্রকার উপাদানকে অন্য কোন তথ্যসূত্রের উপর নির্ভর করতে হয় না। (অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে প্রাথমিক উপদানগুলি হল প্রায় ডিরোজিওর শিষ্যগণ কর্তৃক প্রকাশিত পার্থেনন পত্রিকা, হেসপেরাস ও ক্যালকাটা লিটারারি গ্যাজেট, তদানিন্তন হিন্দু কলেজের দলিল ও চিঠিপত্র, এনকোয়ের্যার ও জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকা, বেঙ্গল স্পেকটেটর পত্রিকা এবং অন্যদিকে সংবাদ চন্দ্রিকা, সংবাদ প্রভাকর, রামতনু লাহিড়ি ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, ইত্যাদি সমকালীন ও প্রায় সমকালীন পত্রপত্রিকা ও দস্তাবেজ যেগুলি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের দ্বারাই লিখিত।
গৌণ উপাদান (Secondary Sources)
গৌণ উপাদান অর্থাৎ যে ঐতিহাসিক স্বাক্ষ্য গ্রন্থ বা দলিলগুলি প্রাথমিক উপাদানে প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তীকালে রচিত বা সংকলিত, যে কোন ঐতিহাসিক গবেষণার ক্ষেত্রে এই উপাদানগুলি খুব কার্যকরী কারণ এগুলি পাঠ করেই পরবর্তীকালের গবেষক প্রাথমিক উপাদানের উপর ধারণ লাভ করতে পারেন। (যেমন ইয়ং বেঙ্গলের উপর গবেষণা করতে গেলে বঙ্গীয় রেনেসাঁস এর উপর ঐতিহাসিক সুশোভন সরকার রচিত “On the Bengal Renaissance”, ঐতিহাসিক সুমিত সরকার রচিত “A Critique of Colonial India” তে ইয়ং বেঙ্গল সংক্রান্ত প্রবন্ধ এবং এই বিষয়ে পরবর্তীকালে সাধিত যে কোন গবেষণাপত্র গৌন উপাদান রূপে ব্যবহৃত হবে এছাড়াও এই বিভাগ অনুসরণে প্রান্তিক উপাদান বা ‘Tertiary Sources’ কেও স্থান দেওয়া হয়ে থাকে যা ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অনেক সময় কাজে লাগে -যেমন অভিধান, বিশ্বকোষ, মানচিত্র, ভূগোল বা আনুষাঙ্গিক কোন বিষয়ের (Ancillary Sciences) কোন গ্রন্থ ইত্যাদি।
লিখিত বা পাঠযোগ্য (Written Records)
লিখিত বা পাঠযোগ্য অর্থাৎ পাঠযোগ্য হরফে লেখা যে কোন স্বাক্ষ্য যা থেকে ইতিহাসের তথ্য আহরণ করা যায় (যেমন অর্থশাস্ত্র, ইন্ডিকা, পেলোপোএনশীয় যুদ্ধের ইতিহাস, যে কোন সরকারী দলিল দস্তাবেজ, চিঠিপত্র, ইত্যাদি যে কোন সাহিত্যগত উপাদান, এমনকি লেখমালা বা লিপি খোচিত মুদ্রা এক্ষেত্রে যা লেখা আছে তা পাঠযোগ্য হলেই তা লিখিত উপাদানের মদ্যে পড়বে ।
দর্শনযোগ্য বা দৃষ্টিগোচর উপাদান
দর্শনযোগ্য বা দৃষ্টিগোচর উপাদান (Visual Documents) অর্থাৎ যেগুলিকে দেখে সমকালীন ইতিহাস বা নিকটবর্তী কোন সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব।
মৌখিক বা কথ্য উপাদান (Oral traditions and Oral History)
মৌখিক বা কথ্য উপাদান অর্থাৎ কেবল মুখে মুখে চলে আসা ট্র্যাডিশান বা কোন ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষ্য বহনকারী ব্যক্তির কথা বা তার দ্বারা প্রদত্ত বিবরণ এই ধরণের পর্যায়ভূক্ত (যেমন, হেরোডোটাস তাঁর গ্রন্থটি লিখেছিলেন বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত মৌখিক ভাষ্যের উপর, যেমন ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহের সময়ের গান থেকে ঐ বিদ্রোহের ঘটনার অনেক কথা জানা যায় বা ১৯৪৭ এর দেশভাগের স্মৃতি পত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিপিবদ্ধ করা হয়ে থাকে।
মূল্যায়ন:
বস্তুতপক্ষে উপদান বা তথ্যসূত্র নিজের কথা বলে না তারা একটি সময়ের এক বা একাধিক মানুষ বা মানবগোষ্ঠীর কথা বলে। ঐতিহাসিক যতটা সম্ভব নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে উপাদান বা তথ্যের ভাষাকে পড়ে অতীতের ভাষ্যকে তুলে ধরেন।