ভারতের জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চার প্রধান বৈশিষ্ট্য
আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিচহাসচর্চায় দ্বিতীয় প্রধান ধারাটি হল জাতীয়তাবাদী। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠা হয়। শিক্ষিত ভারতীয়রা দুটি কারণে ইতিহাসচর্চার কথা ভেবেছিলেন। একটি হল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকদের ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির ওপর আক্রমণের জবাব দেওয়া, অপরটি হল ভারতের জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা করা। ইতিহাসকে জাতি গঠনের একটি প্রধান উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়। বিদেশিরা বলেছিল ভারতীয় জাতি বলে কিছু নেই, ভারত হল বহুজাতিক একটি দেশ। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়রা বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তার ঐতিহ্যের অনুসন্ধানে মনোনিবেশ করেছিল। বিদেশিরা ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির দুর্বলতাকে বেশি করে, ফলাও করে প্রচার করেছিল।
বৈশিষ্ট্য:
1) রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন জাতীয়তাবাদীরা ইতিহাস গবেষণার মাধ্যমে ইতিহাস সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণাগুলি দূর করার চেষ্টা করেছেন। এতে বৈজ্ঞানিক ও সমালোচনামূলক ইতিহাসচর্চার কোনো ক্ষতি হয়নি। একথা ঠিক জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের সকলে ইতিহাস বিজ্ঞানের দাবি অনুযায়ী চলেননি, আবেগ বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। অনেকে প্রাচীন ভারতের গৌরব আবিষ্কারের ওপর জোর দিয়েছেন, প্রচার করেছেন। রাজনারায়ণ বসু বা শশধর তর্কচূড়ামণিরা এধরনের কাজ করেছেন। পরে এ. সি. দাশ ও বি. ডি. বসু জাতীয়তাবাদের প্রভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ইতিহাস লেখেন।
2) সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকদের তাঁরা এভাবে জবাব দেবার চেষ্টা করেছেন। আত্মমর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠা করা ছিল এদের লক্ষ্য। অতীতের গৌরবগাথা স্মরণ করে তাঁরা বর্তমানের দুঃখ দুর্দশা ভুলতে চেয়েছিলেন। তাঁরা বৈদিক সভ্যতাকে স্থাপন করলেন হরপ্পার আগে, ভারতের ঐক্য ও সংহতির ওপর জোর দিলেন, বললেন আধ্যাত্মিকতার কথা।
3) জাতীয়তাবাদীরা জোর দেন অর্থনৈতিক শোষণের ওপর, ভারতের দারিদ্র্য, শিল্প-বাণিজ্যের অবক্ষয়, সামরিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি, আর্থিক নিষ্কাশনএসব বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। তিনি মনে করেন জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের জন্য এদেশে সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ ঘটে। তাঁরা মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে হিন্দু রাজাদের সংগ্রামকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেন। তাঁরা মারাঠা, রাজপুত ও শিখদের কৃতিত্বকে প্রচার করেন। এতে মুসলমান মানসে আঘাত লেগেছিল, জিন্নাহ্র অনেক আগেই জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা ভারত বিভাজনের বীজ বপন করেন
4) জাতির মানসলোকে এরা অনুভূতি ও আবেগকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন, দেশবাসী আত্মপরিচয় পেয়ে দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। জাতীয় আন্দোলনে এদের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। রোমিলা থাপার জানিয়েছেন যে এদের গবেষণার ফলে আঞ্চলিক ও স্থানীয় ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়েছে।
5) ইতিহাসচর্চা আর শুধু গাঙ্গেয় অববাহিকায় সীমাবদ্ধ ছিল না, আঞ্চলিক ও স্থানীয় স্তরে স্থানীয় ভাষায় বহু উপাদান আবিষ্কৃত হয়েছে, ভারত ইতিহাসচর্চা বৈচিত্র্যপূর্ণ, সজীব ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। মহারাষ্ট্র, বাংলা ও দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস পৃথকভাবে রচিত হয়েছে।
6) জাতীয়তাবাদীদের সবচেয়ে বড়ো অবদান হল এঁরা ভারতের আর্থিক দুর্দশার চিত্রটি তুলে ধরেছেন। দেশের মানুষ এঁদের লেখায় প্রথম এদেশের শোষণ ও ভয়ংকর দারিদ্র্যের কথা জেনেছিল। এরাই ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস রচনার পথিকৃৎ। জাতীয়তাবাদীরা শুধু রাজনৈতিক বা সামরিক ইতিহাসের কথা বলেননি, তাঁরা জোর দেন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ইতিহাসের ওপর। কবি ও দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ দেশের মানুষের কাছ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে সামাজিক ইতিহাস রচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
7) জাতীয়তা বাদীদের মধ্যে একটি গোষ্ঠী (ঈশ্বরীপ্রসাদ, আর. পি. ত্রিপাঠী, তারাচাঁদ ও অন্যান্যরা) হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা বলেছিলেন। এঁদের মতে, মুসলিম শাসনাধীনে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বড়ো ধরনের বিরোধ ছিল না, নীচের তলায় হিন্দুরা ছিল শাসকগোষ্ঠী। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষার প্রয়াস চালিয়েছে।
মূল্যায়ন:
অধ্যাপক বি. শেখ আলি জাতীয়তাবাদী ইতিহাসচর্চার কয়েকটি ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিকরা যুক্তি নয়, আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয়ে ইতিহাস লিখেছেন। ইউরোপের রোমান্টিক যুগের ঐতিহাসিকদের সঙ্গে তিনি এদের তুলনা করেছেন (Historical writing of the nationalist period in India bears analogy to the European historiography of the Romanticist era, where emotions and sentiments played the vital role and hisotry was written not on the basis of reason but on instinct)। এদের রচনা জাতীয়তাবাদী ইতিহাসে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারেনি কারণ রক্ষণশীলরা এই গোষ্ঠীর ঐতিহাসিকদের নেতৃত্ব দিয়েছিল।