অশোকের কৃতিত্বের মূল্যায়ন আলোচনা করো।
অশোকের কৃতিত্বের মূল্যায়ন নিহিত রয়েছে কলিঙ্গ যুদ্ধের পর তাঁর ব্যক্তি জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আমূল পরিবর্তনের মধ্যে। মানুষের হতাহতের ঘটনায় অনুশোচনায় কাতর হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থের দিকে তাকিয়ে তিনি কলিঙ্গবাসীকে তাঁদের রাজ্য ফিরিয়ে দেননি।
অশোক ব্যক্তিগতভাবে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হলেও দেশ ও বিদেশের মানুষের মধ্যে তিনি এক সার্বজনীন ধর্ম তথা কল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।মৌর্য সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে ও বাইরে যেভাবে জনগণের মধ্যে ধর্মপ্রচারের উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন তারই ফলে বৌদ্ধধর্ম জগতের অন্যতম সার্বজনীন ধর্মে পরিণত হয়েছে।
শুধু বৌদ্ধ ধর্ম নয়, সকল সম্প্রদায়ের ধর্মের উন্নতি বিধান তাঁর কাম্য ছিল। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, পরধর্মকে সম্মান দেখালে ধর্মের গৌরব বৃদ্ধি ঘটে এবং তার সূত্র ধরে সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের (ব্রাহ্মণ, আজীবিক, জৈন) অন্তর্ভুক্ত মানুষের উন্নতি ঘটে।
কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক নিজে যুদ্ধনীতি পরিত্যাগ করা ছাড়াও তাঁর পুত্র ও পৌত্রদের যুদ্ধনীতি অনুসরণ না করার কথা ঘোষণা করে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এই ঘোষণা মৌর্যসাম্রাজ্যকে হিংসার পরিবর্তে একটি শান্তিবাদী অহিংস রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে সাহায্য করেছিল। এর ফলে যুদ্ধ পর্বের পরিবর্তে এক শান্তি ও সামাজিক অগ্রগতির পর্ব শুরু হয়। এছাড়া বিচারব্যবস্থায় পূর্বতন বৈষম্য দূর করে ‘দণ্ডসমতা’ ও ‘ব্যবহার সমতা’র মাধ্যমে তিনি ন্যায়সঙ্গত বিচারব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটান।
তাঁর আমলে সাঁচী, সারনাথ, গয়ার নিকটস্থ বারাবার পর্বত গুহা প্রভৃতি স্থানে নির্মিত হয়েছিল অসংখ্য স্তূপ ও চৈত্য, যেগুলি স্থাপত্যের অভূতপূর্ব নিদর্শন। এছাড়া, ভাস্কর্যের অভাবনীয় বিকাশ লক্ষ করা যায় তাঁর সময়ে উৎকীর্ণ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে লিপি সম্বলিত স্তম্ভগুলিতে।
সমকালীন রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান ছিল প্রখর। বস্তুবাদী ঐতিহাসিক ডি. ডি. কোসাঙ্গীর দৃষ্টিতে। অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু দ্য স্টাডি অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন যে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিশাল সংখ্যক মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্য কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক পুনরায় রাজ্য বিস্তারের পরিবর্তে তাদের সংহতি রক্ষার ওপর জোর দেন এবং এরই প্রতিফলন ঘটে তাঁর ব্যাপক জনকল্যাণমূলক কর্মসূচীর মধ্যে ।
রুশ ঐতিহাসিক বোনগার্দ লেভিন এর মতে “কূটনৈতিক বুদ্ধি অবলম্বনের মাধ্যমে তখনও পর্যন্ত অধিকৃত নয়, এমন ভূখণ্ডে নিজ খ্যাতি ও প্রতিপত্তিকে সংহত করে তোলার জন্য অশোক সার্বিক প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন” । এই কারণেই তিনি অবিজিত রাষ্ট্রগুলির অধিবাসীদের প্রতি পিতৃসুলভ মমতা ও সবরকম সাহায্যের কথা ঘোষণা করেন এবং ‘ধম্ম’ প্রচারে নিযুক্ত কর্মচারী ও কূটনৈতিক দূতদের ওপর নির্ভরশীল হন।
অশোক বাস্তববাদী ছিলেন। প্রয়োজনে কূটনৈতিক বুদ্ধির প্রয়োগ ঘটাতেও তিনি দ্বিধা করেননি। এতদ্সত্ত্বেও মানবপ্রেমিক অশোকের মহত্ত্ব কোনো ভাবেই ম্লান হবে না। ইতিহাসে তিনি চিরকাল একজন আদর্শ মানুষ ও শাসক হিসাবে সুবিদিত হয়ে থাকবেন।