অশোকের ধম্ম এর প্রকৃতি ব্যাখ্যা করো । অশোকের ধম্ম এর প্রকৃতি আলোচনা করো।
অশোকের ‘ধম্মে’র প্রকৃতি সম্পর্কে পণ্ডিতদের মধ্যে তীব্র মতানৈক্য আছে।ঐতিহাসিক মনে করেন, অশোকের ‘ধম্ম’ ও বৌদ্ধ ধর্ম ছিল এক ও অভিন্ন। অর্থাৎ অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ হল বৌদ্ধ ধর্ম। আর এক শ্রেণীর পণ্ডিতের কাছে মনে হয়েছে, তাঁর ‘ধৰ্ম্ম’ বৌদ্ধ ধর্ম বা কোনো একটি বিশেষ ধর্ম নয়। উভয়পক্ষই নিজ নিজ তত্ত্বের সমর্থনে যথাযথ যুক্তি উত্থাপন করেছেন। বস্তুত, অশোক তাঁর বিভিন্ন শিলালেখয় এ বিষয়ে যে সমস্ত কথা বলেছেন এবং প্রধান প্রধান বৌদ্ধগ্রন্থগুলিতে মহামানব বুদ্ধদেবের যে সমস্ত নীতি বা শিক্ষা বিধৃত হয়ে আছে সেগুলির আলোকে এই দ্বন্দ্বের নিরসনে প্রয়াসী হওয়াই শ্রেয় হবে।
যে সমস্ত পণ্ডিত অশোকের ধম্ম ও বৌদ্ধ ধর্মকে এক ও অভিন্ন বলে মনে করেন।তাঁর অশোক গ্রন্থে “অশোকের ধর্ম্ম” নামে একটি অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তিনি যে সিদ্ধান্তে এসেছেন তা হল অশোকের ‘ধৰ্ম্ম’ নিশ্চিতভাবে বৌদ্ধ ধর্ম। বেশ কিছু তথ্যের ভিত্তিতে তিনি এই তত্ত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর প্রথম ও প্রধান যুক্তি হল অশোক ছিলেন খাঁটি বৌদ্ধ। কেননা, তৃতীয় অপ্রধান শিলালেখ (ভাব্রু লেখ) ও মাসকিতে প্রাপ্ত প্রথম অপ্রধান শিলালেখ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন।
অষ্টম মুখ্য শিলালেখ এবং প্রথম ও দ্বিতীয় অপ্রধান স্তম্ভলেখ থেকে জানতে পারা যায় যে, অশোক বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী গ্রাম, বোধিলাভ ক্ষেত্র বোধগয়া ও পূর্ববুদ্ধ কনক মুনির স্তূপ প্রভৃতি বৌদ্ধ তীর্থক্ষেত্রগুলিতে ভ্রমণ করেছিলেন। তাঁর সময়েই পাটলিপুত্রে তৃতীয় বৌদ্ধসভার অধিবেশন বসেছিল (আনুমানিক ২৫০ খ্রিস্টপূর্ব)। ভাণ্ডারকার তাঁর তত্ত্বকে সুদৃঢ় করার জন্য অশোকের লেখমালায় উদ্ধৃত ধৰ্ম্ম সংক্রান্ত বিষয়গুলির সঙ্গে বৌদ্ধজগতের অন্যতম গ্রন্থ ‘ধম্মপদ’ ও দীর্ঘ নিকায়-র অন্তর্ভুক্ত ‘লক্ষণ-সুত্তও’-য় উল্লেখিত ধর্মীয় নীতিগুলির সাযুজ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
আবার ভৃত্য, ক্রীতদাস, ব্রাহ্মণ ও শ্রমণদের প্রতি যে উদার ও ভদ্র আচরণের কথা অশোকের সপ্তম স্তম্ভলেখতে বলা হয়েছে বৌদ্ধগ্রন্থ ‘ধৰ্ম্মপদ’-য় সেগুলিরও উল্লেখ আছে। এছাড়া ‘ধম্মদান’-এর শ্রেষ্ঠত্বের কথা অশোকের প্রধান লেখ (নবম ও একাদশ) ও ‘ধৰ্ম্মপদ’— উভয় স্থলেই উল্লেখিত হয়েছে। ‘যে ব্যক্তি নৈতিকতাহীন তার ধর্মাচরণ হয় না’— অশোকের চতুর্থ প্রধান শিলালেখর এই কথা ‘ধৰ্ম্মপদ’-তেও আছে।
তৃতীয় অপ্রধান শিলালেখর ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন ডি. আর. ভাঙারকার। কারণ এই লেখতে অশোক বলেছেন যে, ভগবান বুদ্ধের সমস্ত বাণীই হল অতি উচ্চতম। বুদ্ধদেব, বৌদ্ধ ধর্ম ও বৌদ্ধসংঘের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ও অনুরাণের কথাও অশোক এতে স্বীকার করেছেন। সর্বোপরি, ঐ লেখতে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষু, ভিক্ষুণী, উপাসক, উপাসিকা— সকলের জন্য কিছু বৌদ্ধ ধর্মপুস্তক নির্ধারিত করে দিয়েছেন। এই পুস্তকগুলি হল—১. বিনয় সমুৎকর্ষ, ২. আর্যবাসা, ৩. অনাগতভয়ানি, ৪. মুনিগাথা, ৫. মৌনেয় সুত্ত, ৬. উপতিষ্য প্রশ্ন, ৭. রাহুল্লাবাদ।ভান্ডারকারের বক্তব্য হল, যেহেতু এই বৌদ্ধ ধর্মপুস্তকগুলি অশোক তাঁর লেখতে লিপিবদ্ধ করেছেন সেহেতু তাঁর ‘ধম্ম’ ছিল বৌদ্ধ ধর্ম।
অশোকের ‘ধম্ম’ যে বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে এক ও অভিন্ন নয় তার পিছনেও যথেষ্ট যুক্তি দেখিয়েছেন প্রথিতযশা কিছু ইতিহাসবিদ। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রিস ডেভিডস, জে. এফ. ফ্লিট, আর. কে. মুখার্জী, ডি. ডি. কোসাম্বী, ডি. সি. সরকার, রোমিলা থাপার প্রমুখ। লক্ষণীয় বিষয় হল ডি. আর. ভাণ্ডারকার তাঁর মতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে সমস্ত উপাদানের সাহায্য নিয়েছেন এই শেষোক্ত মতবাদে বিশ্বাসী ঐতিহাসিকেরাও ঐ উপাদানগুলিকেই ব্যবহার করেছেন। বলাবাহুল্য, উভয়ের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য হেতু সিদ্ধান্তেরও পার্থক্য ঘটেছে স্বাভাবিকভাবেই।
উপরিউক্ত ইতিহাসবিদগণ, যাঁরা সম্রাট অশোকের ‘ধম্ম’ নীতিকে বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে এক ও অভিন্ন বলে মনে করেন না, তাঁরা অশোকের লেখমালাকে দুভাগে ভাগ করেছেন এবং দুটি ভাগের মধ্যে স্পষ্ট ও সুগভীর পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। একটি ভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ভাব্রু, সারনাথ ও লুম্বিনী লেখতে, যেগুলি তাঁর ব্যক্তিগত লেখর পর্যায়ে পড়ে। কারণ এগুলিতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হিসাবে বৌদ্ধসংঘ ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাঁর গোঁড়া ধর্ম বিশ্বাসের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়, সুতরাং, তিনি যে বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সম্রাট তথা জনগণের অভিভাবক হিসাবে তাদের মঙ্গলার্থে অশোকের ধর্মীয় আদর্শের কথা প্রচলিত হয়েছে অন্য এক শ্রেণীর লেখতে। এই শ্রেণীর লেখগুলি হল প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ অপ্রধান শিলালেখ : তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, সপ্তম, ত্রয়োদশ প্রভৃতি প্রধান শিলালেখ এবং দ্বিতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ও সপ্তম স্তত্তশাসন। স্তত্তশাসনগুলি স্থাপন করা হয়েছিল জন সমাগম সম্পন্ন এলাকায়। ঐ সমস্ত অনুশাসনগুলিতে অশোক জনসাধারণের উদ্দেশ্যে ‘ধম্ম’-র কথা ঘোষণা করেছিলেন। উল্লেখ্য, বৌদ্ধ ধর্মের একান্ত অনুরাগী হলেও কোনো ব্যক্তি বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর তিনি তা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেননি। জনসাধারণকে তিনি কিছু নৈতিক আচরণ মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছেন এবং সেগুলিকেই তিনি সমস্ত ধর্মের সারাংশ বলে মনে করতেন।
শিলালেখ ও স্তম্ভলেখসমূহে তিনি যে সমস্ত নৈতিক আচরণের কথা বলেছেন সেগুলি আগে উল্লেখিত হওয়ায় এখানে পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। তবে সেগুলির জের হিসাবে বলা যেতে পারে যে তাঁর ‘ধৰ্ম্ম’ . ছিল সরল ও সকলের ব্যবহারের উপযোগী। কোনো জটিল দার্শনিক তত্ত্ব সেখানে স্থান পায়নি। অবশ্য ঐ নৈতিক আচরণগুলির মধ্যে হিন্দু ও বৌদ্ধ ভাবধারার স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়—তথাপি এগুলি নতুন । অশোকের আগে কোনো শাসক বা ধর্মপ্রচারক প্রজাসাধারণ বা জনগণের উদ্দেশ্যে এ ধরনের পথের নির্দেশ করেননি। তাই এগুলি তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবন বা আবিষ্কার বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। এখানে আরো একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ‘ধম্ম’-র মধ্যে কোনো বিশেষ ধর্মের কথা স্থান পায়নি।
সাধারণ বিবেকসম্পন্ন মানুষের যা করা উচিত সম্রাট অশোক তাঁর ধম্ম এর মধ্যে তাই অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এই কারণে কোনো কোনো পণ্ডিত তাঁর ধম্মকে কোন নির্দিষ্ট ধর্মের পর্যায়েই ফেলতে রাজি নন। রিস ডেভিডস এঁদের মধ্যে অন্যতম। ডি. ডি. কোসাম্বী, রোমিলা থাপার প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতের ভিত্তিতে আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে শ্রেণী-সংঘর্ষ এড়াতে ও মৌর্য রাষ্ট্রের সংহতি রক্ষার তাগিদে অশোক ঐ ধরনের ধর্মীয় নীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অশোকের ‘ধর্ম্ম’কে বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে অভিন্ন করে দেখার প্রচলিত ধারণা সম্পর্কে তাই যথেষ্ট সংশয় প্রকাশ করেছেন ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপারও।
মূল্যায়ন
বস্তুত, যে-নৈতিক আচরণগুলির কথা অশোক প্রচার করেছিলেন সেগুলি খাঁটি বৌদ্ধ ধর্মের সারবস্তু নয়। জে. এফ. ফ্লিট, আর. কে. মুখার্জী, দীনেশচন্দ্র সরকার সকলেই মনে করেন যে অশোকের প্রচারিত ধর্মমত ছিল বিভিন্ন নীতির সমন্বিত রূপ। তা মোটেই নিটোল বৌদ্ধ ধর্ম নয়।এছাড়া বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম প্রধান ভিত্তি অষ্টাঙ্গিক মার্গ ও নির্বাণ লাভ সম্পর্কেও অশোক তাঁর ধৰ্ম্মে কোনো কথা বলেননি।